
পর্ব ১০
মনীষা ভট্টাচার্য: আকাশের গায়ে কখনও মেঘ কখনও রৌদ্র। প্রকৃতি শীতের চাদর বিছিয়ে বিরাজমান। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রে আনতে আনলক-৭ এ কন্টেনমেণ্ট জোনে কড়াকড়ির ঘোষণা। সঙ্গে একের পর এক বিখ্যাত মানুষের মৃত্যুমিছিল তো রয়েইছে। এই পরিস্থিতে শহর, গ্রাম-গঞ্জ সবই বেরঙিন। মেলা নেই, জলসা নেই, নেই সার্কাসও। শীতের মরশুমে গ্রামের দিকে যে একটু যাত্রাপালা বেঁচে ছিল তাও এবার বন্ধ। অগত্যা রেডিওই ভরসা। উত্তর কলকাতার কানা গলিতে এই হেমন্তবেলায় যাত্রাপালা শোনা যাবে, এ আমার কাছে বিস্ময়!’ ‘কী নাম যাত্রাপালার?’ ‘প্রখ্যাত নট্ট কোম্পানির গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম পালা’। ফিরতি পথে মনে হল, বাংলার সংস্কৃতির এই আদি মনোরঞ্জনের জন্ম কবে? কোথায়? আকাশবাণীর অন্দরে যাত্রাপালার কোনও প্রচেষ্টা হয়েছে কী কখনও? এই উত্তর খুঁজতেই আজকের তরঙ্গ কথা।
উনিশ শতকে বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের বৈকুণ্ঠ নট্ট ও শশীভূষণ নট্ট একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন নট্ট কোম্পানি যাত্রা দল। পরবর্তীতে এই যাত্রাদলই হয়ে উঠেছে অত্যন্ত জনপ্রিয় নট্ট কোম্পানি। মূলত গ্রামবাংলার মেঠো সুরেই পৌরাণিক কাহিনিকে কেন্দ্র করে পালা রচিত হত। বর্তমানে যাত্রা শব্দটা চিৎপুর রোডের মধ্যেই আটকে আছে। সরকারি উদ্যোগে জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চে প্রায় একমাসের একটি যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আকাশবাণী থেকে প্রকাশিত ‘বেতার জগত’ পত্রিকায় (১৯৭২) একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে ‘আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের কৃষিবিভাগ আয়োজিত দু’মাস ব্যাপী বেতারে যাত্রা উৎসব শুরু হচ্ছে ৪ অক্টোবর’।
কলকাতা বেতার ৯টি পেশাদার দলকে আমন্ত্রণ করে এই উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। বেতার জগতে এই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ছিল উৎসবের সূচী। দেশভাগে বাংলার পেশাদার যাত্রা অন্ধকারের মুখে পড়লে যাত্রা তার নিজস্বতা হারাতে বসে। পেশাদার যাত্রার সঙ্গে পেশাদার থিয়েটারের মিশ্রণে সময়োপযোগী হওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। ‘যাত্রা ও থিয়েটার’ শীর্ষক প্রবন্ধে অবন ঠাকুর লিখছিলেন, ‘খাঁটি যাত্রা দুর্লভ হয়েছে, থিয়েটার যাত্রাই চলছে এখন, সেই কারণে খাঁটি যাত্রার ঠিক রূপটা পাওয়া মুশকিল এবং তাঁর পুরো চর্চাও অসম্ভব।’

আদি যাত্রার খোঁজে আকাশবাণী এগিয়ে আসে। নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার, নলিনীকান্ত সরকার ও সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর মিলিত প্রয়াসে আদি, মধ্য ও আধুনিক এই তিন পর্যাযের যাত্রা প্রযোজনার চেষ্টা করে আকাশবাণী। নলিনীকান্ত সরকারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, আধুনিক যাত্রা দলের খোঁজ পেতে কোনও অসুবিধে হয়নি। চিৎপুরের যাত্রা আর যাত্রা নয়, তার নাম থিয়েট্রিক্যল অপেরা পার্টি। কিন্তু মধ্যযুগ ও আদিযুগের যাত্রা দলের সন্ধান পাওয়াটা বেশ মুশকিল ছিল। চিৎপুরে প্রথমে কেউ কোনও হদিশ দিতে না পারলেও, পরে ওখানেরই এক বয়স্ক মানুষের কাছ থেকে জানা যায়, বিষ্ণুপুরে একটা দল আছে, যাঁরা চোকরা ও জুড়িদের নিয়ে পৌরাণিক পালা অভিনয় করে। তাছাড়া আদি যাত্রা পালা অনেকদিনই উঠে গেছে। এই আদি যাত্রপালার নাম ছিল ‘কৃষ্ণযাত্রা’। এই ‘কৃষ্ণযাত্রা’-র পালা হল গানের পালা, কথা থাকে খুব কম। অবশেষে ১৯৩৭ সালে তিনযুগের যাত্রাভিনয় বেতারে করা সম্ভব হয়েছিল।
জেলেপাড়া থেকে আগত দলটি আধুনিক যাত্রার অভিনয় করেছিলেন এবং আদি ও মধ্যযুগীয় যাত্রার অভিনয় করেছিলেন বিষ্ণুপুর থেকে আগত একটি দল। কোনও দর্শক নেই, আলো নেই, চারদিক খোলা কোনও মঞ্চ নেই, শুধু সংলাপের মাধ্যমেই যাত্রাভিনেতারা শ্রোতার মন জয় করছেন। মঞ্চনাটক এবং বেতার নাটকের থেকে যাত্রার বেতার উপস্থাপনা সেদিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। গ্রামবাংলার মানুষের কাছে আজও বেতার যাত্রার আকর্ষণ অত্যন্ত লোভনীয়। কৃষিবিভাগের বিচিত্রানুষ্ঠানে আজও ৪০-৪২ মিনিটের যাত্রাপালা প্রচারিত হয়। একটা সময়ে একটি পালা রেডিওতে পরিবেশিত হলে পালাকার পেতেন ৪০ টাকা, আর দল পেত ১০০টাকা। ১৯৭০ সালের পর এই টাকার পরিমাণ অবশ্য অনেকটাই বাড়ে। চিৎপুরের পেশাদার যাত্রাদলগুলির পক্ষে বেতারে অভিনয় করা সম্ভব ছিল না, কারণ তাদের দু- আড়াই ঘণ্টার পালাকে ছোট করে ৪০ মিনিটে আনা ছিল বেশ কষ্টকর। তবু চিৎপুরের যাত্রাদলগুলির সঙ্গে বেতারের একটি বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপন হয়েছিল। বেতারের ভাষায় এই ধরণের অনুষ্ঠানকে বলা হয় স্পনসর্ড প্রোগ্রাম।
১৯৭০ সালেই, মে মাসে লিভিং সাউন্ড এজেন্সির মাধ্যমে নিউ প্রভাস অপেরা তাদের একটি পালার বিজ্ঞাপন দেন বিবিধ ভারতীতে। ঠিক এক সপ্তাহ পর সেই অনুষ্ঠানে যাত্রালোক দল যোগ দেয়। তারপরের সপ্তাহে অংশ নেয় লোকনাট্য দল। এইভাবে আস্তে আস্তে প্রায় প্রতিটি পেশাদার দলই চারশো টাকার বিনিময়ে তাদের উপস্থাপন রাখতেন। সময়সীমা ছিল মাত্র দশ মিনিট। ১৯৯৯ সালে একটু ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনের জন্য মহাজাতি সদনে পুনরায় একটি যাত্রা উৎসবের আয়োজন করে, সেখান থেকে সাতটি পেশাদার দলের জনপ্রিয় পালাগুলি রেকর্ডিং করে বেতারে প্রচারিত হয়েছিল। সেই সাতটি দল ছিল ভৈরব অপেরা, নট্ট কোম্পানি, নবরঞ্জন অপেরা, ভারতী অপেরা, মুক্ত মঞ্জরী, সত্যনারায়ণ অপেরা, মোহন অপেরা। এই বিশেষ অনুষ্ঠানটির দায়িত্বে ছিলেন আকাশবাণী কলকাতার নাট্যবিভাগের প্রধান ড. দীপকচন্দ্র পোদ্দার। ওই একই বছরে ড. দীপকচন্দ্র পোদ্দারের ব্যবস্থাপনায়, কলকাতা কেন্দ্র থেকে উনিশ মিনিটের ‘যাত্রাগান’ শীর্ষক একটি তথ্য ভিত্তিক অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়, যা ‘আকাশবাণী অ্যানোয়াল অ্যাওয়ার্ড’ পায়। এই অনুষ্ঠানটির ভাষ্যকার ছিলেন দেবাশিস বসু।

তথ্য বলছে, আকাশবাণীর পল্লিমঙ্গল আসরে বিভিন্ন সময় যাত্রাপালা অভিনয়, পালাগান, যাত্রাগান প্রচারিত হয়েছে। এই আসরের পরিচালক সুধীর সরকার যাত্রাগানকে খুবই জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। সুধীরবাবু বেশ কয়েকটি পালা রচনাও করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য নারী বর্জিত পালা রচনা করে তিনি পরীক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠানও করেছিলেন। তাঁর রচিত পালাগুলির মধ্যে অবশেষে, পরিচয়, মাটির মা, সাধনার অন্তরালে উল্লেখযোগ্য।
আকাশবাণীর সংগ্রহশালায় আমরা পাব বীণা দাশগুপ্ত, মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীলা মজুমদার, জ্যোৎস্না দত্ত, পান্না চক্রবর্তী, স্বপনকুমার প্রমুখ বিশিষ্ট যাত্রা ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার। মনে প্রশ্ন জাগে চিৎপুরে যাত্রাদলের সংখ্যা কত? খোঁজ খবর করে জানা গেল এখনও প্রায় শতাধিক যাত্রাদল তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার লড়াই লড়ছেন। নতুন অভিনেতা অভিনেত্রীদের কর্মশালার মাধ্যমে তুলে আনার চেষ্টাও করছেন। এই নতুনদের নিয়ে রথযাত্রার শুভমুহূর্তে নতুন পালা রচনা করে তা পরিবেশিতও করছেন দর্শকদের সামনে। তাছাড়া কোন যাত্রাপালা সারা বছরে কতবার অভিনীত হল তার বিচারে যাত্রাদলকে পুরস্কৃত করা হয়। সম্মানিত করা হয় যাত্রার অভিনেতা অভিনেত্রীদের। তবে সারাদিন, ২৪ ঘণ্টা গ্রামবাংলার মানুষের কাছে যাত্রাদল পৌঁছতে না পারলেও জনপ্রিয় যাত্রাপালা তাদের কাছে পৌঁছে যায় আকাশবাণীর মাধ্যমে।