পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুমিছিল, দায় কার?
শান্তনু অধিকারী, সবং: দেশজুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের হাহাকার আজও অব্যাহত। ফুরিয়েছে নগদ, ফুরিয়েছে অন্নের সংস্থান। অনেকেই উৎখাত হয়েছেন তাঁদের দিনান্তের আশ্রয় থেকেও। অর্ধাহারে, অনাহারে তাঁরা আজ নিতান্তই নিরূপায়। এই পরিস্থিতিতে বহু রাজ্যের পরিযায়ীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন রাস্তায়।
কেউ বেরিয়ে পড়েছেন কয়েকশো কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে বাড়ি পৌঁছোতে। কেউ চেপে বসছেন পন্যবোঝাই লরির মাথায়। কেউ হাঁটা দিচ্ছেন রেলপথ ধরে। ফলে প্রায়শই ঘটছে দুর্ঘটনা। ক্লান্ত শ্রান্ত পরিযায়ীর দল তাঁদের অজান্তেই পড়ে যাচ্ছেন অসহায় মৃত্যুর কবলে। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন, এমন তিনজন গবেষক তেজেশ জিএন, কনিকা শর্মা ও আমন জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত লকডাউনের ভোগান্তিতে মৃত্যু হয়েছে মোট ৩৮৩ জনের। এর মধ্যে পথ ও রেল দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছে ৭৭ জনের। সেই মৃত্যুমিছিলের বহর কমার কার্যত আজও কোনও লক্ষণ নেই। বেড়েই চলছে পরিযায়ীদের মৃত্যুর পরিক্রমা।
আজই যেমন হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশে দুটি পৃথক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই পরিযায়ী শ্রমিক। গতকালই খড়্গপুর লাগোয়া রূপনারায়ণপুরে পুরুলিয়ার এক পরিযায়ী শ্রমিকের লরির তলায় পিষ্ট হওয়ার খবর মিলেছে। এর আগে গত ৮ মে ঔরাঙ্গাবাদের মর্মান্তিক ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে সারা দেশ। ২০ জন পরিযায়ী শ্রমিকের একটি দল ১৫০ কিলোমিটার দূরে ভূসাবলে যাচ্ছিলেন রেল লাইন ধরে হেঁটে। ভূসাবল থেকে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন ধরে ঘরে ফেরার কথা ছিল তাঁদের। প্রায় ৬৫ কিলোমিটার একটানা হাঁটার পরে বদনাপুর ও করমাডের মাঝামাঝি এসে ক্লান্তিতে রেললাইনের উপরেই ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁরা। সেই সময় ঘুমের মধ্যেই একটি মালগাড়ি তাঁদের পিষে দিয়ে চলে যায়। ঘুমের মধ্যেই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান ১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিক।
সেই দুর্ঘটনার রেশ মিলাতে না মিলাতেই ১০ মে’র ভোর রাতে আবার দুর্ঘটনা। মারা গেলেন ৫ জন শ্রমিক। তেলঙ্গানার হায়দরাবাদ থেকে একটি আমভর্তি ট্রাক যাচ্ছিল উত্তরপ্রদেশের আগরায়। ওই ট্রাকেই উঠে পড়েছিলেন জনা ১৫ পরিযায়ী শ্রমিক। রবিবার সকালে মধ্যপ্রদেশের পথ গ্রামের কাছে দ্রুতগতিতে যাওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় ট্রাকটি। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৫জন। আহত ১১, যাঁদের মধ্যে দু’জনের সংকট এখনও কাটেনি। মহারাষ্ট্র থেকে হেঁটে উত্তরপ্রদেশে ফেরার সময় মধ্যপ্রদেশের বারওয়ানি জেলায় প্রবল গরম ও ক্লান্তিতে মৃত্যু হয়েছে ৩ পরিযায়ী শ্রমিকের। লকডাউনে আটকে পড়ে ত্রিপুরার জোলাইবাড়িতে এক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে গত শুক্রবার।
লকডাউন শুরুর কয়েকদিন পরেই ২৮ মার্চ কর্ণাটকের রায়চুড়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৮ পরিযায়ী শ্রমিকের। তেলেঙ্গানা থেকে হেঁটে ছত্তিশগড় ফিরতে গিয়ে প্রবল জলকষ্টে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মাত্র ১২ বছর বয়সী জামালো মাকদম। জঙ্গলের পথে ১০০ কিলোমিটার হাঁটার পরেও বাড়ি পৌঁছাতে পারেনি একরত্তি মেয়েটা। বাড়ির সামান্য দূরেই শেষ হয়ে যায় তার জীবনের চলার পথ। তামিলনাড়ু বাসস্ট্যান্ডেও এক বছর আশির পরিযায়ীর মৃত্যুসংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল একাধিক সংবাদ মাধ্যমে।
মৃত্যু নিয়ে রাজনীতির চিরকালীন ঐতিহ্য মেনেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। শুরু হয়েছে কেন্দ্র রাজ্যের চাপানউতোর। এইযেমন গতকালই এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় দাবি করেন― পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র নজর দেয়নি কেন্দ্র। দুর্ঘটনার যাবতীয় দায় তাই কেন্দ্র সরকরকেই নিতে হবে। রাজ্যের বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা আবার রাজ্যের সদিচ্ছার অভাবকেই ইঙ্গিত করেন। পাল্টা পরামর্শ দিয়ে বলেন, রাজ্যসরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
ঔরঙ্গাবাদের রেলদুর্ঘটনায় পরিযায়ীদের মৃত্যুতে বিচলিত হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। তিনি গভীর শোকপ্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এতগুলো প্রাণ একসঙ্গে শেষ হয়ে গেল। আমরা মর্মাহত।’ তিনি সবরকমের সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন। তবু শুরু হয়েছে কেন্দ্রকে দোষারোপের পালা। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সাংসদ ডাঃ মানসরঞ্জন ভূঞ্যা স্পষ্ট অভিযোগ করে বললেন, ‘দেশের বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে কেন্দ্রসরকারের যে ভূমিকার কথা বলা হয়েছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তা মানছেন না।’ এ রাজ্যের পরিযায়ীদের ফেরানৈর প্রসঙ্গে কেন্দ্রকে দুষে তিনি বলেন, ‘রাজ্যসরকার পরিযায়ীদের ফেরানোর জন্য একশোটি ট্রেনের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত রাজ্য পেয়েছে সাকুল্যে আটটি।’
পাল্টা তোপ দেগেছেন বিজেপি’র জেলা সভাপতি শমিত দাসও। জানালেন, ‘রেলদপ্তর ট্রেন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। কোথায় কত পরিযায়ী রয়েছেন, সেই হিসেব মোতাবেক রাজ্যকেই তো জানাতে হবে রুটম্যাপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজ্যসরকার এখনও পর্যন্ত সেটি রেলমন্ত্রককে জানাতে পারেনি।’ এ প্রসঙ্গে রাজ্যকে দুষে তিনি আরও জানালেন, ‘ ভিনরাজ্যের পরিযায়ীদের যোগ জন্য রাজ্যসরকারের তরফে একাধিক ফোন নাম্বার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে ফোনগুলোতে কোনও সাড়া মেলে না।’ আজ অব্দি রাজ্যসরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা প্রস্তুতির কাজটিও শেষ করে উঠতে পারেনি বলেই অভিযোগ তুললেন তিনি। রাজ্যের একশোটি ট্রেনের দাবির প্রসঙ্গে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন শমিত― ‘ক্ষমতা থাকলে সেই দাবির প্রমাণ দিক রাজ্য।’
কিন্তু লকডাউনের আগেই কেন পরিযায়ীদের ফেরার সুযোগ দিল না কেন্দ্র? শমিতবাবু জানালেন― ‘ওইটি করতে দিলেই শুরুতেই গোষ্ঠী সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকত। একে অজানা ভাইরাস, তারওপরে দেশের সবজায়গার চিত্রটিও স্পষ্ট ছিল না সরকারের কাছে। ফলে করোনা সংক্রমণের হাল বোঝার জন্য এই সময়টা নেওয়া জরুরি ছিল।’ প্রায় পঞ্চাশদিন পেরিয়েছে লকডাউনের মেয়াদ। দেশের মানুষ বুঝেছেন। সচেতন হয়েছেন। এই মুহূর্তে পরিযায়ীদের ঘরে ফেরানোটা অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে করছেন শমিতবাবু। কারণ, সংক্রমণের গতিরোধ এখনও করা সম্ভব হয়নি। ফলে ভিনরাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে ফিরিয়ে আনাই শ্রেয়। নাহলে রাজ্যের উদাসীনতায় প্রাণ যাবে আরও পরিযায়ীর। মহারাষ্ট্র, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্য থেকে এখনও পরিযায়ীদের ফেরাতে নারাজ রাজ্য। এ প্রসঙ্গে শমিতবাবু বলেন, ‘পরিযায়ীদের এভাবে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়াট উচিত হচ্ছে না।’ পরিযায়ীদের দ্রুত ফেরানোর দাবিতে তাঁরা ইতিমধ্যে রাজ্যব্যাপী আন্দোলনেও নেমছেন বলে জানালেন তিনি।
তবে মানসবাবু, শমিতবাবু দু’জনেই মানছেন, এই বিপর্যয়ের থেকে বাঁচতে কেন্দ্র ও রাজ্যের বোঝাপড়া অত্যন্ত জরুরি। এ নিয়ে রাজনীতি করাটা মোটেও কাম্য নয়। কিন্তু কাম্য না হলেও পরিযায়ীদের মৃত্যু ঘিরে চাপানউতোরেই রয়েছে রাজনীতির দুর্বিষহ গন্ধ। ‘বোঝাপড়া চাই’ বললেও বোঝাপড়া হচ্ছে কই! সেই তো মৃত্যুর মিছিলে দেশজুড়ে হাঁটছেন পরিযায়ীরা। যাঁদের রক্তেঘামে সভ্যতার এগিয়ে চলা, তাঁরাই আজ অপাংক্তেয়, অবয়বহীন। রাজনীতির তরজায় তাঁরা নিতান্তই অসহায় বোড়ে। ঔরঙ্গাবাদের রেললাইনের রক্তাক্ত রুটিগুলোই আজ এ দেশের পরিযায়ীদের দুর্দশার প্রতীক হয়ে উঠেছে!