বিদেশ সচিবকে ঢাকায় পাঠিয়ে হাসিনাকে কী বার্তা দিলেন মোদি ?

পান্থ রহমান:
সময়টাকে রীতিমতো অস্থির করে রেখেছে কোভিড-১৯। গোটা বিশ্বই ব্যাতিব্যস্ত। জীবন গতি পাবে কী, বরং জীবন বাঁচিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জের। আবার সেই চ্যালেঞ্জও কোন বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের নয়; সবার। এশিয়ার এই দক্ষিণাংশও চ্যালেঞ্জটা ভালোই টের পাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে বরং চ্যালেঞ্জটা বাকি অঞ্চল বা দেশগুলোর তুলনায় বেশিই। কারণ, এ অঞ্চলের অর্থনীতি। উঠতি এবং ক্রম অগ্রসরমান হলেও আমাদের এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কাঠামোয় সাম্য নেই। অর্থাৎ এ কাঠামো সর্বত্র সমান নয়। সে কারণেই, কোভিডের মতো একেবারে নতুন কিন্তু কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের সামর্থ বলতে গেলে তৃতীয় বা চতুর্থ গ্রেডের। আর সে কারণেই, আমাদের ঐক্য জরুরী। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় জোটবদ্ধ থাকা জরুরী।
যদিও খাতাকলমে আমাদের জোট আছে কিন্তু সমস্যা হলো, আদতে সেই জোট থেকেও নেই। হতে হতেও আমাদের জোটটা হয়ে ওঠেনি। তার কারণ আমাদেও অজানা নয়। একটু যাদের চোখকান খোলা তারা জানেন যে; আশির দশকে দক্ষিণ এশিয়াকে একাট্টা করতে যে বন্ধন গড়ে তোলা হয়েছিলো, দিনে দিনে তার গাঁট ঢিলে হয়ে গেছে। আর তাই সম্ভবনার জোট হওয়া সত্ত্বেও ‘সার্ক’ বলতে গেলে নিস্ক্রিয়। অনেকে আর একে নিস্ক্রিয় বলতেও রাজি নন, তাদের মতে ‘ডেড হর্স’।
কিন্তু কিছু কিছু কঠিন সময়ে তো আমাদের একসঙ্গে থাকতেই হয়। এই যেমন বৈশি^ক মহামারি কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর গোটা বিশে^র মতো এশিয়ার এই দক্ষিণাংশও যখন বিপাকে, তখন একে অন্যের পাশে না থাকলে চলবে কী করে? কিন্তু সেটা তো হবার নয়। বরং উল্টোই দেখছি আমরা। করোনাকালেও আমরা এ অঞ্চলের বিভেদ স্পষ্ট টের পেয়েছি। শুধু বিভেদই নয় বরং বিভেদটা আরও স্পষ্ট হয়ে ‘বৈরি’ হয়েছে। একে অন্যের বিরুদ্ধে আঙুল তুলতেও দেখছি এই সময়টাতে। তাতে একাট্টা হওয়া দূরের বরং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। তার ওপর আবার দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও ছড়িয়ে পরেছে এই বৈরিতা। সে কারণেই জোটবদ্ধ হওয়ার সম্ভবনা ফিঁকে হয়ে গেছে আরও।
তাই বলে কী রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে আমাদের সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে? সেটা হতে দেওয়াও কী ঠিক হবে?
সম্ভবত এসব চিন্তা করেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার দূত পাঠিয়েছিলেন ঢাকায়। সেই ওদূতও আবার ঢাকার পূর্ব পরিচিত এবং কাছের মানুষ। যদিও হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা নামের সেই মানুষটি ‘কাছের মানুষ’ হিসেবে ঢাকা সফর করেননি বরং সফর করেছেন নিজ পদবির জোরেই। তাতে পোয়া বারো হয়েছে। দু’দেশই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছে তার আকষ্মিক ও ঝটিকা সফরে।
কী বার্তা ছিলো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর? ঠিক কী নিয়ে আদতে কথা বলেছেন বিদেশ মন্ত্রকের সচিব হর্ষ বর্ধন? সেই বিষয়টা সত্যিই মুখ্য নয়। আমার মতে, তার সফরটাই গুরুত্বপূর্ণ। তার সফরটাই একটি ‘বার্তা’। সেই বার্তা, সহযোগিতার।
এখনও এ অঞ্চলে কোভিডের শঙ্কা কমেনি। এখনও কেউ দেশের বাইরে তো দূর ঘরের বাইরে পর্যন্ত যাচ্ছেন না। সেই মুহুর্তে অর্থাৎ কাভিড এবং কোভিড-পরবর্তী ‘নিউ নরমাল’ সময়ের সন্ধিতে ভারতের উচ্চ পর্যায়ের এই নীতি নির্ধারকের প্রথম বিদেশ সফর হলো ঢাকায়। এখানেই এই সফরের মাহাত্ম। কারণ, তিনি সফর শুরু করলেন দক্ষিণ এশিয়া দিয়ে। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশকে দিয়ে। আর এর মাধ্যমে সহযোগিতার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি পাশে থাকার প্রতিশ্রতিও দিলো ভারত। তৈরি হলো উদাহরণ। এখন বাকি সবাই মিলে এই উদাহরণ অনুশীলন করা প্রয়োজন।
২.
যদিও এ সফর নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা হয়েছে, হচ্ছে এবং আরও কিছুদিন হবেও। এর মূল কারণ অবশ্য ভূ-রাজনীতি। অনেকে এই সফরের সঙ্গে ভারত-চীন- বাংলাদেশ সম্পর্ক জড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত ভাবার চেষ্টা করেছেন। সেভাবে চাইলে আপনি ভাবতেই পারবেন। কারণ ‘দু’য়ে দু’য়ে চার’-এর মতো সহজ হিসেবটা আপনার হাতেই; আপনি একে যেভাবে দেখতে চাইবেন, হিসেবটা তেমনই হবে! আপনি আপনার হিসেব যেভাবে মেলাতে চাইবেন, সেভাবেই মিলবে। ার তাতে চীনের সঙ্গে ভারতের টানাপোড়েনের পর ‘বাংলাদেশ-চীন’ সম্পর্ক নিয়ে আপনি এভাবে ভাবতে চাইলে; আপনার সেই ভাবনাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। তাছাড়া ভাবার সুযোগও তো থাকছে। আর তাই হঠাৎ করে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের গা’ঘেষা সম্পর্ককে মিলিয়ে আপনি নিজের মতো একটা সিদ্ধান্তে আসতেই পারেন। আপনার ব্যাক্তিগত ভাবনা ঠেকানো দায় কিংবা দায়িত্ব কোনটাই কেন নিতে পারবে না।
কিন্তু ব্যাক্তিগতভাবে এই সফরকে আমি কেবলই ‘সহযোগিতার সফর’ ভাবতে চাই। কেবলই প্রয়োজনীয় সময়ে বন্ধুত্বের বার্তা বাহকের সফর বলেই ভাবার ইচ্ছে আমার। চীন-ভারত সম্পর্কের শীতলতার বিষয়টি জানা থাকলেও আমি ওদিকে পা মারাতে চাই না। বরং কঠিন সময়ে ভারত হাত বাড়িয়েছে বলে তাদের সাধুবাদ দিতে চাই। আর সব মিলিয়ে বিষয়টিকে কেবলই দ্বিপাক্ষিক এবং সহযোগিতার; তেমনটাই ভাবার ইচ্ছে।
জানি যে আপনার মন থেকে প্রশ্নটা যাচ্ছে না; কেন এই হঠাৎ সফর?
এই প্রশ্ন যে আমার মনে আসছে না, তা নয়। ভারতের মতে, ভ্যাকসিন সহযোগিতায় বাংলাদেশের নামটা সবার আগে আসে বলেই এখানে তাদের আশা। এই কথাটুকু মেনে নিতে আপনার কতটা আপত্তি জানা নেই, তবে আমার খুব আপত্তি নেই। আমি বরং একে একটু বাণিজ্যিক; আরো স্পষ্ট করে বললে ‘দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট’ ইস্যু হিসেবেই বিবেচনা করছি।
আসুন একটু সেই পথে হাঁটি। যেহেতু এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিনটি প্রক্রিয়াধীন এবং মানব শরীরে পরীক্ষা-নিরাক্ষার ব্যাপার আছে। ভারতীয় উৎপাদনকারীরা চাইছে নিজের দেশের বাইরেও একে ভিন্ন দেশে পরীক্ষা করে দেখতে। সেক্ষেত্রে তাদের হাতের কাছে সবচে ভালো বিকল্প নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ। আর যেহেতু কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলে সবচে কাছের প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশকে না দিয়ে তারা পারছেন না, তাই বাংলাদেশেই কেন পরীক্ষা নয়? সেই যুক্তিতে বাংলাদেশও বরং একদিক থেকে তাদের সহযোগি বা অংশীই হলো। তাহলে কূটনীতির ভাষায় তো একে ‘উইন-উইন’ বলাই যায়। এভাবে দেখার সুযোগ থাকতে আমি কেন সফরটিকে ভূ-রাজনীতির অংশ বানিয়ে ফেলতে যাবো?
৩.
নিন্দুকের একাংশ হর্ষ বর্ধণ শ্রীংলার সফর নিয়ে ঢাকার রাখঢাক আর আহ্লাদিপনাতেও বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু খোলাসা করে তাদের সমস্যাটা বলছেন না। ঘুরে ফিরে সেই ভূ-রাজনীতির পথ না মারিয়ে আমার মতে, একটু ভিন্নভাবে দেখতে চেষ্টা করুন। বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অংশ হিসেবে নিন, দেখবেন ইস্যুটি ‘জলবৎ তরলং’!
গফরের একটা দিক ছিলো করোনাকালের চ্যালেঞ্জ। আরও আছে করোনা পরবর্তী সময়ে সবচে বড় চ্যালেঞ্জ, অর্থনীতি পুনুরুদ্ধার। সেখানেও সহযোগিতার কথাই বলতে চেয়েছে ভারত। সেক্ষেত্রেও ভারতকে যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন, তেমনি বাংলাদেশেরও প্রয়োজন শক্তিশালী পড়শি ভারতের সহযোগিতা। এরই মধ্যে খুলতে শুরু করেছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। একে একে সীমান্ত দিয়ে আসতে শুরু করেছে ভারতীয় পণ্য। যদিও ক’টা দিন বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে অস্থিরতা ছিলো কিন্তু সেই সমস্যাও মিটে যাচ্ছে। তাই অর্থনীতি পুনুরুদ্ধার কিংবা সচল করে তোলাও এই সফরের একটা বড় উদ্দেশ ছিলো; সেকথা সাফ জানিয়ে গেছেন শ্রীংলা।
আর সফরের সুযোগে বাংলাদেশও তাদের ওজর-আবদার আর অভিযোগের কথা শুনিয়ে দিতে পেরেছে। পাশাপাশি প্রতিবেশি হলে যেমন দু’একটু এ’মনা-ও’মনা হয় তেমনি সমস্যা তো দু’দেশের মধ্যেও আছে। সেই কথাটিই বাংলাদেশ বলেছে ‘উদ্বেগ’ হিসেবে। জানিয়েছে, হঠাৎ করে সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি। আর খুব মনোযোগি শ্রোতা হিসেবে তা সমাধানের আশ^াসও দিয়েছেন ভারতের বিদেশ সচিব।
তাছাড়া আগামী বছর থেকে এক বছরের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হতে যাচ্ছে ভারত। এটাকেও সুযোগ হিসেবে দেখছে বাংলাদেম। মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমিমাংসিত ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট’ সমাধানে ভারতের এই নতুন পজিশন কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ। বলা বাহুল্য, সেখানেও ভারত পূর্ণ সহযোগিতা দেবে বলেই আশ^স্থ করেছে।
তাহলে চীনের বাংলাদেশ ঘেষা সম্পর্কের কারণে যদি এই সফর হয়েও থাকে তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি কী? বরং হিসেবের খাতায় তো ‘পজিটিভ’! এটুকুর জন্য হলেও তো নিন্দামন্দ বন্ধ করা যায়, তাই তো?