মানুষের অজ্ঞানতায় হারিয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিশিখা’

ভাস্করব্রত পতি, তমলুক : স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নাম দিয়েছেন ‘অগ্নিশিখা’ ফুল। তবে পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষ একে বলে ‘কাকমারা ফুল’ বা ‘কাওয়ামারা ফুল’। আসলে এই জেলার কাকমারা সম্প্রদায় তথা তেলুগু শবর মানুষ জন তাঁদের মাথায় লাল ফেট্টি বা ‘রুয়াকোটা’ তে গুঁজে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করতে বের হয়।
আজ নগর সভ্যতার বাড়বাড়ন্তে এবং ক্রমশঃ জঙ্গল কমে যাওয়ায় হারিয়ে যাওয়ার পথে এই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা ফুলগাছটি। আমাদের অজ্ঞানতাও এই ফুলের জীবনে আঁধার নিয়ে আসছে।
আসল নাম ওলটচণ্ডাল। বিজ্ঞানসম্মত নাম Gloriosa superba। এটি Colchicaceae পরিবারভুক্ত। জিম্বাবোয়ের জাতীয় ফুল এটি। ১৯৪৭ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর ২১ তম জন্মদিনে রোডেশিয়া (এখনকার জিম্বাবোয়ে) ভ্রমনকালে এই ফুলের আকারে হিরের উপহার দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বর্তমানে তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজ্য ফুলের তকমা দেওয়া হয়েছে একে। তামিল ভাষায় একে কিঝাঙ্গু, সেঙ্গানথাল এবং কানভালি নামেও চেনে। ইংরেজিতে Flame Lily, Climbing Lily, Tiger Claw, Fire Lily, Glory Lily এবং Creeping Lily ও বলে।
বিশ্বে ৭৭ টি পরিবারের ফুল রয়েছে যাঁরা নিয়মিত রং বদলায়। তাঁদের মধ্যে একটি এই ওলটচণ্ডাল ফুল। মূলতঃ অ্যান্থোসায়ানিনের জন্য এরকম ঘটনা ঘটে। খেজুরি কলেজের অধ্যাপক ড. অসীম কুমার মান্না বলেন, আমরা একে ‘বিষফুল’ বলে খেলতাম ছোটবেলায়। এই ফুল প্রথমে ক্রিম সাদা রঙের হয়। পরের দিন ফুলের পাঁচটি পাঁপড়ির মুক্ত প্রান্তের দিকে অর্ধেক অংশ হলুদাভ হয়ে ওঠে। এবং গোড়ার দিকে মলিন সাদা বা ক্রিম রঙের থাকে। তৃতীয় দিন পাঁপড়িগুলির একপ্রান্তের এক তৃতীয়াংশ উগ্র লাল, মাঝে হলুদাভ এবং গোড়ার দিকে ক্রিম রঙের দেখায়। চতুর্থ দিন প্রায় পুরোটাই লাল হয়ে যায়। কিন্তু মুক্ত প্রান্তের রং আরো গাঢ় লাল রঙের হয়। ভাদ্র আশ্বিন মাসে এই ফুল ফুটতে দেখা যায়।
উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় এর পুষ্পবিন্যাসকে বলে Lax Corymbose Inflorescence। অত্যন্ত বিরল ধরনের পুষ্পবিন্যাস। এঁদের প্রতিটি পাঁপড়ি ঢেউখেলানো। পাঁপড়িগুলির দৈর্ঘ্য ৭-৮ সেমি এবং প্রস্থ ১ সেমি হয়। কুঁড়ি অবস্থায় নিচের দিকে মুখ থাকলেও ফোটার সময় গর্ভাশয় ও গর্ভদণ্ডের থেকে অন্যান্য ফুলের পাঁপড়ি যেমন সাধারনভাবে ৯০ ডিগ্রি কোনে ঘুরে যায়, এঁদের ক্ষেত্রে কিন্তু পাঁপড়িগুলি পুনরায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ঝিমিয়ে নিম্নমুখী হয়ে ঝুলে থাকে। আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায় এভাবেই। যেন লজ্জা পেয়েছে তাঁর রূপ যৌবন হারিয়ে! তাই উপকূলীয় লোকমুখে ‘লজ্জাবতী ফুল’!
ভেষজ গাছ হিসেবেই পরিচিত গ্রামাঞ্চলে। কাঁথির অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট লেখক ড. অমলেন্দুবিকাশ জানা বলেন, এখানকার মানুষ জনের মুখে এটি ‘ল লাঙ্গুলিয়া’ গাছ নামেই পরিচিত। আসলে বায়বীয় কাণ্ডের প্রতিটি গাঁট থেকে এর পাতা জন্মায়। সেই পাতাগুলো তেমন চওড়া তেমন লম্বা। পাতার ডোগা সরু হতে হতে আকর্ষে পরিনত হয়। যা অনেকটা হনুমানের লেজ বা লাঙ্গুলের মতো জড়িয়ে ঝোপঝাড়ের শীর্ষে পৌঁছে যায়।
Gloriosa superba ছাড়াও পৃথিবীতে মেলে G. Simplex, G. lutea, G. carsonii, G. Rothschild Jana, R. virescens, R. abyssinica এবং Methonica superba প্রজাতির ওলটচণ্ডাল। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় গাছ এটি। এর টিউবারাস রাইজোমতে মেলে বিষাক্ত অ্যালকালয়েড ‘কলচিসিন’ এবং ‘গ্লোরিওসিন’।
মানুষ সহ গরু, ঘোড়া, বেড়াল, কুকুরদের কাছে খুব বিষাক্ত এই গাছ। তবে সাধারণত এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ। ভারতে এর রাইজোম ব্যবহৃত হয় সন্তান জন্মানোর সময় প্রসববেদনা লাঘবের জন্য। এছাড়া সাপে কামড়ানো, গাউট, বন্ধ্যাত্ব, কলেরা, কিডনি সমস্যা, আলসার, কাটাছেঁড়া, স্মলপক্স, ক্যানসার, যৌনরোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয় বহুলভাবে।
ক্ষীরাই নদীর পাড়ে ঝোপজঙ্গলে এখন এই বর্ষাকালে প্রচুর ফুটেছে। কিন্তু সরকারি বনসৃজনের নামে অজান্তেই কেটে ফেলা হচ্ছে এই গাছগুলোকে। হলদিয়া শিল্পাঞ্চল এলাকার কোথাও কোথাও ফুটতে দেখা যাচ্ছে। তবে তা সংখ্যায় কম। গ্রামাঞ্চলে প্রায় দেখাই যায়না আগের মতো। উদ্ভিদবিদ্যার দুই গবেষক মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক ড. পার্থপ্রতিম মাইতি এবং বিশিষ্ট শিক্ষক কৃশানু সিংহ বলেন, উদ্ভিদ গবেষনার স্বার্থে এই ফুলকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। এ ধরনের গাছ সচরাচর দেখা যায় না।
আমাদের রাজ্যের মতো ওড়িশাতেও কমে গিয়েছে এই গাছ। অষ্ট্রেলিয়ার উপকূল এলাকায় এখন দেখা যাচ্ছে। এছাড়া কুইন্সল্যান্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলসের উপকূল এলাকায় মিলছে। সিঙ্গাপুর, কুক আইল্যান্ড, কিরিবাটি, ফ্রেন্চ পলিনেশিয়াতে এই গাছ এখন ‘ইনভেসিভ স্পিসিস’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আসলে এখন এক শ্রেনীর লোভী ব্যবসায়ীর লোভের শিকার এই গাছটি। অথচ বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাঁচানোর এবং বংশবৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেই কারোর। ফলে ক্রমশঃ হারিয়ে যাওয়ার পথে ঔষধি গাছ ‘ওলটচণ্ডাল’ তথা ‘অগ্নিশিখা’।