
যুগশঙ্খ ডিজিটাল ডেস্ক: বাঁচার জন্য খাওয়া নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচা – এ ভাবনার কোনও মিমাংসা নেই। তবে যার জন্যই যা হোক না কেন, রসনা তৃপ্তিতে তৎপর হই আমরা সবাই। আলুসেদ্ধ ভাত পরম তৃপ্তি দিলেও, মাঝে মাঝে আমাদের স্বাদকোরকগুলি একটু বদল চায়। আর সেই বদল অবশ্যই সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে রেখেই আমরা করতে চাই। কেউ কেউ আবার সারা পৃথিবীর কড়াই খুন্তির লড়াইকেই চেখে দেখতে চান। সেই কথা মাথায় রেখেই যুগশঙ্খ ডিজিটালে বিশ্ব কুইজিন । আজ প্রবাসী।
একটা সময় ছিল যখন বাইরে খাওয়া বলতে বুঝতাম হোটেলে খাওয়া। তারপর সময়ের সঙ্গে পাল্টে হয়ে গেল রেস্টুরেন্ট । ন’য়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আবার এই রেস্টুরেন্টই হল রেস্তোরাঁ। এটি ফরাসি শব্দ। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে আধুনিক রেস্তোরাঁর ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু এক সময় অথিতিশালা, সরাইখানা-ই ছিল হোটেল বা রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁ বলতে সাধারণত আমরা যে ধরনের খাবার বুঝি তার উদ্ভব ১১২৩ সালে চিনের সং সাম্রাজ্যের হাংঝৌ শহরে। সেখানে ভাতের ওয়াইন থেকে নুডলসের স্যুপ সবই পাওয়া যেত। আধুনিক এই রেস্তোরাঁর সূচনা হয় ফ্রান্সে ১৭৬৫ সালে। তবে মতভেদ আছে। সে যাই হোক।
ফরাসিরা এক সময় উপনিবেশ গড়েছিল আমাদের রাজ্যের হুগলি জেলার চন্দননগরে। রাজত্ব করেছে বেশ কিছুসময়। আজও সেই জায়গায় গেলে দেখতে পাওয়া যায় ফরাসি স্থাপত্য। তাছাড়া ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রেও চন্দননগরের ভূমিকা রয়েছে। এতো কথার পর আশা করি বুঝতেই পারছেন আজকে প্রবাসী-তে ফরাসি ফ্লেভারের কথাই হবে।
ফ্রেঞ্চ অনিয়ন স্যুপ
বাঙালি রান্নায় স্যুপ এই ব্যাপারটা খুব একটা নেই। তবে পশ্চিমী রসনায় স্যুপের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। আজ তাই প্রথমে থাকছে ফ্রেঞ্চ অনিয়ন স্যুপ। ইতিহাস বলছে রোমান জমানা থেকে এই স্যুপের জনপ্রিয়তা। আঠেরোশো শতকে এর জন্ম প্যারিসে। যদিও এই মুহূর্তে বাংলায় পেঁয়াজের দাম আকাশ ছোঁয়া, কিন্তু তথ্য বলছে প্যারিসে সেই সময় এই স্যুপ গরিব লোকেরা খেত কারণ সেখানে পেঁয়াজ খুবই সহজলভ্য । আগেই বলেছি খাবারের স্বাদ বদলে যায় রান্নায় ব্যবহৃত মশলার কারণে, তাই মন দিয়ে লক্ষ করুন কী কী লাগছে স্যুপ তৈরিতে। ফরাসি এই স্যুপ বানাতে লাগবে পেঁয়াজ, মাখন, অলিভ অয়েল, গোলমরিচ গুড়ো, রেড ওয়াইন বা আপেল সিডার, ভেজিটেবল ব্রথ , চিজ, স্প্রিগস থাইম, নুন, চিনি ও ময়দা। এইসব উপকরণই আমাদের হাতের কাছেই থাকে। স্প্রিগস থাইম অর্থাৎ একরকম সুগন্ধি পাতা তাও আশা করি মলে পেয়ে যাবেন। এবার শুরু করা যাক রান্না। বড় হলে ৩টি আর ছোট হলে ৪-৫টি পেঁয়াজ নিয়ে খুব পাতলা করে কুচো করে নিন। এবার প্যানে তেল এবং মাখন দিয়ে গরম করে নিয়ে পেঁয়াজ কুচো দিয়ে দিন। নেড়ে চেড়ে ঢাকা দিয়ে রেখে দিন। কিছুক্ষণ বাদে ঢাকনা তুলে নুন, গোলমরিচ গুড়ো এবং অল্প চিনি দিয়ে আবার ঢেকে দিন। চিনি দিলে পেঁয়াজ বাদামি হবে তাড়াতাড়ি। এই সময় একটু বাদে বাদে ঢাকনা খুলে দেখতে হবে যাতে পেঁয়াজ লেগে না ধরে।
বাদামি হয়ে এলে এক চামচ (টেবল চামচ) ময়দা ছড়িয়ে দিন। ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে রেড ওয়াইন কিংবা আপেল সিডার দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। মিনিট খানেক পরে দিন সবজি সেদ্ধ জল বা ভেজিটেবল ব্রথ। এখানে আপনারা কোনো মাংসের (চিকেন/ল্যাম্ব/বিফ)স্টকও দিতে পারেন। এবার ভালো করে ফুটিয়ে নামানোর আগে ছড়িয়ে দিন স্প্রিগস থাইম। মাথায় রাখবেন পুরো রান্নাটা মিডিয়াম ফ্লেমে করতে হবে। এবার বড় বোলে স্যুপ নিয়ে ওপরে ক্রিসপি পাউরুটি (টুকরো বা স্লাইস) দিয়ে গ্রেটেড চিজ দিয়ে দিন। চিজ একটু বেশি দিতে পারেন। স্যুপের গরমে চিজ মেল্ট হয়ে এক স্বর্গীয় লুক দেবে যা দেখেই আপনার জিভে জল আসতে বাধ্য ।
ব্যোর ব্লঁ
পশ্চিম মানেই আমাদের কাছে দ্রুতগতির জীবন। আমাদের মনে হয় ওদের হাতে কেটে-বেটে রান্না করার সময় কই? আমরাও এখনদৌড়চ্ছি। আমাদের হাতেও সময় নেই। তাই চলুন চট জলদি বিশ শতকের এক ফরাসি রান্না করে ফেলি। ব্যোর ব্লঁ। বাটার সস নামেও এটি পরিচিত। স্যুপ বানানোর জন্য পেঁয়াজ তো কেটেই ছিলেন । যদি সবটা খরচ করে না থাকেন তাহলে আর নতুন করে পেঁয়াজ কাটতে হবে না। নইলে একটা ছোটো পেঁয়াজ কুচো করে কেটে নিন। এছাড়া মাখনের পরিমাণটা এক্ষেত্রে একটু বেশি লাগবে। আর লাগবে হোয়াইট ওয়াইন ও হোয়াইট ওয়াইন ভিনিগর। এখানে বলে রাখি প্রায় পুরো ইউরোপই চিজ ও মাখন একটু বেশি খায়। তাই যখন কোনও অথেন্টিক রান্না করবেন তখন উপকরণগুলোও যেন ঠিক থাকে। নইলে কিন্তু ফিঊশন হয়ে যাবে।
প্যানে একটু বাটার দিয়ে কেটে রাখা পেঁয়াজকুচো দিয়ে দিন। খুব হালকা করে ভাজুন। অল্প আঁচে রান্নাটা করতে হবে। হালকা ভাজা হয়ে এলে তাতে হোয়াইট ওয়াইন ও হোয়াইট ওয়াইন ভিনিগর দিয়ে দিন। এবার ক্রমাগত নাড়তে নাড়তে জলটা পুরোটা শুকিয়ে নিন। এবার অল্প অল্প করে বাটার দিতে থাকুন এবং ক্রমাগত নাড়তে থাকুন। মাথায় রাখবেন বাটার মেল্ট হবে, গরম হবে কিন্তু ফুটবে না। সেই মতো গ্যাসের আগুনকে অন-অফ করবেন। ২৫০-৩০০ গ্রাম মাখন এই রেসিপিটি তৈরি করতে লাগবে। হয়ে এলে একটি ছাকনিতে দিয়ে পুরোটা ভালো করে ছেঁকে নিতে হবে।
এতোটা পড়ে ভাবছেন এতো বাটার সস হয়ে গেল। এ দিয়ে খাব কী? চিন্তার কারণ নেই। বাড়িতে আলু এবং ভিন্ন স্বাদের সবজি নিশ্চয়ই আছে। সেগুলিকে কাটুন কিংবা গোটা রেখেই সেদ্ধ করুন। সেই সেদ্ধ সবজির ওপর এই বাটার সস দিন এবং পার্সলে পাতা কুচো ও গোলমরিচ ছড়িয়ে খান। আর যদি আপনি নন-ভেজিটেরিয়ান হন তাহলে স্যামন কিংবা টুনা মাছ হালকা তেলে সঁতে করে নিয়ে তার ওপর এই সস দিয়ে খান। ফরাসিরা এই ব্যোর ব্লঁ বানিয়ে এইভাবেই খায়। দুটো পদ বানাতে ৩০-৪০ মিনিটের বেশি সময় কিন্তু লাগবে না। শীতকাল আসছে। এখন প্যারিস যাওয়া সম্ভব নয়, তবে বাড়িতে প্যারিসের খাবার বানিয়ে খেতেই পারেন আর যদি প্যারিস গিয়ে থাকেন তাহলে প্রতি কামড়ে সেই স্মৃতি রোমন্থন করুন।