fbpx
হেডলাইন

আলোর পথপ্রদর্শনকারী দেবী কালিকার আরাধনায় সারা বাংলা

ভাস্করব্রত পতি, তমলুক : মহানির্বাণমতে, যিনি সকল প্রাণীকে ‘কলন’ বা গ্রাস করেন, তিনিই ‘মহাকাল’। এই মহাকালকে গ্রাস করেন আদ্যাশক্তি ‘কালিকা’। তাই বলা হয়, “কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্ত্তিতঃ / মহাকালসা কলনাৎ তমাদ্যা কালিকা পরা”। আর তন্ত্রসার অনুসারে ‘কালী’ হোলো “করালবোদনং ঘোরাং মুক্তকেশিং চতুর্ভুজাম কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাম”। ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীরূপ হল ‘কালী’। অর্থাৎ তামিস্র। কৃষ্ণবর্ণযুক্ত, শ্যমল, অসীত। মসীকজ্জলকালকাআ বা সংস্কৃতে মসীকজ্জলশ্যামকায়াঃ। মহাকালের সঙ্গে যিনি রমণ করেন তিনিই ‘কালী’। কালের অধিষ্ঠাত্রী আদ্যাকালী নানা নামে পূজিতা হন “ত্বং কালী তারিণী দুর্গা ষোড়শী ভূবনেশ্বরী / ধূমাবতী ত্বং বগলা ভৈরবী ছিন্নমস্তকা / ত্বমন্নপুর্ণা বাগদেবী ত্বং দেবী কমলালয়া / সর্ব্বশক্তি ত্বং দ্বিভূজা ষড়ভূজাষ্ট ভূজাস্তয়া / তমেব বিশ্বরক্ষাথং নানা শাস্ত্র ধারিণী”।

কিন্তু কবে প্রথম কালী আরাধনা শুরু হয়? ব্রম্ভবৈবর্ত্তপুরাণে পাই “প্রথমে পূজিতা সাজ কৃষ্ণেণ পরমাত্মানা / বৃন্দাবনে চ সৃষ্টাদৌ গোলকে রাসমণ্ডলে / মধুকৈটভ ভীতেন ব্রম্ভণা সা দ্বিতীয়া / ত্রিপুরাপ্রেসীতে নৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা / ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ সাপার্দ্দুর্বাসস পরা / চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্তা ভগবতী সতী / তদণমুণিন্দ্রৈ সিদ্ধেন্দ্রৈ দেবৈশ্চ মনুর্মানবৈঃ পূজিতা সর্ববিশ্বেসু বভূব সর্ব্বতঃ সদা”। অর্থাৎ বৃন্দাবনে প্রথম কালীপূজার সাধক শ্রীকৃষ্ণ। এরপর মধুকৈটভের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে পূজা করেন ব্রম্ভা। তৃতীয় জন হিসেবে কালীর পূজা করেন দেবরাজ ইন্দ্র। সারা ভারতের মতো পশ্চিমবঙ্গেও কালী আরাধনা হয় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে।

দীপাবলি উৎসবের দিনে কালীপূজার কথা পাওয়া যায় ১৭৬৮ সালে লেখা কাশীনাথের “কালী পর্যাবিধি” অনুসারে। এই গ্রন্থ অনুসারে জানা যায় যে তখন পর্যন্ত কালীপূজা বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল না। কেউ কেউ বলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই এই পূজার প্রচলন করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র সহস্র মণ নৈবেদ্য এবং সহস্র সহস্র কাপড় ও আরো নানাবিধ উপচারে কালীর পূজা করেছিলেন মহারাজের নির্দেশে। তবে অন্যান্যদের অভিমত, সম্ভবত বাংলাদেশে প্রচলিত কালীপূজার প্রবর্তক ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। ইনি ছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভুর তন্ত্র শিক্ষক।

বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে কালীপূজার প্রচলন রয়েছে। মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে রটন্তী কালী, জৈষ্ঠ্য মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে ফলহারিণী কালী, কার্তিকের রাস পূর্ণিমাতে কৃষ্ণকালী ছাড়াও শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, আদ্যাকালী, জিয়ৎকালী, মহাকালী, শ্যামাকালী, নিত্যকালীর পূজার রেওয়াজ আছে। শ্যামাকালী হোলো বরাভয়দায়িনী। আর অতিবৃষ্টি, মহামারী, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রেহাই পেতে রক্ষাকালী এবং সংহারমূর্তিতে শ্মশানকালীর পূজা হয়।

পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে কালী আরাধনায় মেতে ওঠেন মানুষজন। দীপাবলির সময়ে তমলুকের দেবী বর্গভীমা মন্দিরে, মেদিনীপুর শহরের বটতলা চকে এবং কাঁথির কপালকুণ্ডলা মন্দিরে ভক্তসমাগম লক্ষ্য করা যায়। মেদিনীপুর শহরের বটতলা চকে অধিষ্ঠীত দেবীর আরাধনা হয় প্রতিদিনই। জেলার বহু ঐতিহ্যশালী এই পূজোকে ঘিরে দীপাবলির সময় মেতে ওঠেন মানুষজন। তেমনি দেবী বর্গভীমাকে ঘিরে তমলুক শহর শক্তির আরাধনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন সবাই।

ফলহারিণী কালীপূজা দীর্ঘ ২৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে পাঁশকুড়ার ক্ষীরাই নদীর বুকে পাশাপাশি দুটি গ্রাম তিনতাউড়ি বেগুনবাড়ি ও গুলিখানা (ফতেচক) তে। হাজারের বেশি ছাগবলী হয়। ধীবর সম্প্রদায়ের পূজা এটি। তমলুকের আস্তাড়া, পাঁশকুড়ার পরমানন্দপুর, এগরার বাথুয়াড়িতে (১৫০ বছর) সমারোহে পূজিতা হন এই কালী। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার গাংচা এবং শ্রীরামপুর আটঘরাতেও জৈষ্ঠ্যতে ফলহারিণী কালী পূজা শতাধিক বছর ধরে চলছে।

কসবাতে ২৫৯ বছরের বেশি সময় ধরে মুখার্জি পরিবারের পূজা চলছে উত্তরাধিকারীদের উদ্যোগে।
দাসপুরের বাসুদেবপুরে ১২৪১ বঙ্গাব্দে শুরু হয়েছিল শ্মনানকালীর পূজা। এখনও চলছে। এখানকার জোতকেশব গ্রামের কালীপূজাও ২৫০ বছরের প্রাচীন। নন্দীগ্রামের হানুভুঁঞাতে এবং পূর্ব দক্ষিণ ময়নাতে শতাধিক বছরের প্রাচীন কালীপূজা চলে আসছে। তমলুকের কিসমত পুতপুত্যা গ্রামের রক্ষাকালীর পূজা হয় মাঘে। এটিও দেড়শো বছর ছুঁই ছুঁই। চন্দ্রকোনার ডিঙ্গালতে বৈশাখে রক্ষাকালীর পূজা হয় অনেক বছর ধরে। প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন বাগপোতার বৈশাখী রক্ষাকালীর পূজা আজও সমানভাবে চলছে।

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ভগবানপুরের বিভীষণপুরের চক্রবর্তী পরিবারের দক্ষিণাকালীর পূজা চলে আসছে এই দীপান্বিতা অমাবস্যায়। এছাড়া এখানকার জরারনগর, ইছাপুর, ভগবানপুর থানা সদর, সাদুল্ল্যাচক এবং ধালুয়াতেও দেবী কালীর পূজা ভক্তি সহকারে হচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের দশগ্রামে কার্তিকী অমাবস্যাতে বহু প্রাচীন কালীপূজা চলে আসছে। তমলুকের বল্লুক, সাবলআড়া, নারায়ণদাঁড়ি, পটাশপুরের বারুইপুর, বড়হাট, খড়ুই কোটবাড়, মুস্তাফাপুর, গোসাড়া, সদতপুর, পালপাড়া, প্রতাপদিঘী, গোপালপুর, মহিষাদলের ঠাঠারিবাড় ও সন্দলপুরেও দেবী কালীর পূজা জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই আয়োজিত হয় এখনও।

তিনিই কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। যেখানে সমস্ত বর্ণের অভাব, সেখানেই কালো তথা কৃষ্ণবর্ণের আবির্ভাব। আর তাঁর তীব্র জ্যোতি আমাদের চোখ ধরে রাখতে পারেনা। তাই কালো। এই আদ্যাকালীর নির্দেশেই সারা পৃথিবীর শুভাশুভ কাল সৃষ্টি হয়। জগতের অন্ধকার দূর করে দেন তিনিই। যাবতীয় কালো সরিয়ে পৃথিবী জুড়ে আলোর ঝালরে ঢেকে রাখেন এই কৃষ্ণবর্ণা আদ্যাকালীই। “মেঘাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনয়নাং রক্তাশ্বরং বিভ্রতীং”।

Related Articles

Back to top button
Close