রক্তের সংকট মেটাতে আবারও রক্তদান শিবির মেদিনীপুর ছাত্র সমাজের
শান্তনু অধিকারী, সবং: জনৈক কবি লিখেছিলেন― “যদি প্রথা আসে রক্তদানের/গড়ে ওঠে জাতি সতেজ প্রাণের।” দিকে দিকে রক্তের হাহাকারে জাতির সেই প্রাণ আজ অনেকটাই নিস্তেজ। স্তিমিত হয়েছে আলো। দুশ্চিন্তার অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছেন মুমূর্ষু রোগির পরিজনরা। ব্লাডব্যাঙ্কগুলো এমনই রক্তশূন্য যে, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তরাও ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন কখনো-কখনো।
ক্ষীণতর হয়ে উঠছে জীবন আর মৃত্যুর মাঝের সুতোটুকু। এই পরিস্থিতিতে তাই প্রাণের সজীবতা রক্ষায় আবারও এগিয়ে এল মেদিনীপুর ছাত্রসমাজ। “করোনাকে জয় করব আমরা একদিন/ভয়হীন চিত্তে একটি জীবনদানে রক্ত দিন।”― এই স্লোগানকে সামনে রেখে গতমাসের পর আবারও তাদের উদ্যোগে গতকাল মেদিনীপুর শহরে আয়োজিত হল রক্তদান শিবির। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল মেদিনীপুর কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল ও মেদিনীপুর ভলান্টিয়ার ব্লাড ডোনার্স ফোরাম।
মেদিনীপুর শহরে অশোকনগরের বাসিন্দা মনোজ গোস্বামীর বাড়িতেই বসেছিল রক্তদানের আসর। এদিনের এই শিবিরে রক্ত দিলেন সর্বমোট পনেরো জন। শিশির দত্ত, শুভ ঘোষ, বালিকা সিংদের মতো ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি এদিন রক্ত দিলেন পেশায় শিক্ষিকা শর্বরী চক্রবর্তী, শিক্ষক অসিতবরণ খাটুয়া প্রমুখরা। রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন গৃহবধূ সঙ্গীতা সাহাও। এদিন উপস্থিত ছিলেন ভলান্টিয়ার ব্লাড ডোনার্স ফোরামের সভাপতি অসীম ধরও। তিনি বলেন, যেভাবে দিনদিন রক্তের আকাল দেখা দিচ্ছে, তা মুমূর্ষু রোগিদের জন্য রীতিমতো অশনি সংকেত। ভোগান্তি বাড়ছে রোগির পরিজনদের। বেশ কিছুদিন সরকারি নির্দেশে রক্তদান শিবির বন্ধ থাকায় তীব্রতর হয়েছে সংকট। তবে সম্প্রতি রাজ্যসরকার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। তাই অসীমবাবু আশাবাদী, ‘আগামী দিনে ছাত্রসমাজের মতো অন্যান্য সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসবে। চলতি এই রক্তসংকট নিশ্চিতভাবে দ্রুত মিটবে।’
এই লকডাউনের পর্বে মেদিনীপুর ছাত্রসমাজের নানাধরনের সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে মন ছুঁয়েছে সকলের। প্রায় দিনই ত্রাণ নিয়ে ছুটেছে প্রান্তজনের দুয়ারে দুয়ারে। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা-সহ ঝাড়গ্রামের প্রায় সর্বত্র পৌঁছেছে তাঁদের সেবাস্পর্শ। সম্প্রতি উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রায় আড়াই হাজার দুর্গত পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে খাদ্যসামগ্রী। লকডাউনের জেরে শহরের অভুক্ত মানুষদের মুখে দু’বেলা নিয়ম করে তুলে দিয়েছে খাবার।
তবে শুধু এই লকডাউন নয়, সারাবছরই মেদিনীপুর ছাত্রসমাজ নানাধরনের সেবামূলক কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। ইদানীং তাদের সেবাসূচিতে যুক্ত হয়েছে রক্তদান। ছাত্রসমাজের এই কর্মকাণ্ডে রীতিমতো আপ্লুত মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা বিশিষ্ট সমাজসেবী অরিন্দম ভোমিকও। তিনি বলেন, ‘একদিন এই শহরের ছাত্ররাই ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে বিপ্লবের আকাশে ঝড় তুলেছিল। করোনা সংকটের এই আবহে মেদিনীপুর ছাত্রসমাজ যা কাজ করছে, অসাধ্যকে ছোঁয়ার নিরিখে প্রায় সমতুল্য।’
তবে কোনও তুলনায় যেতে নারাজ এই ছাত্রদল। সংস্থার সভাপতি কৃষ্ণগোপাল চক্রবর্তী জানালেন, ‘নিজেদের বিবেকের তাড়নায় যা করার করছি। সমাজের প্রয়োজনে সাধ্যমতো অবদান রাখার চেষ্টা করছি। এরবেশি কিছু নয়।’ রক্তদান শিবির প্রসঙ্গে সংস্থার সম্পাদক রাজকুমার বেরা বললেন, ‘সামাজিক দূরত্ব মেনেই হয়েছে শিবির।’ তবে অনেকেই নাম নথিভুক্ত করেও অনুপস্থিত ছিলেন। খানিকটা আক্ষেপ ঝরে পড়ে সংস্থার অন্যতম সদস্য কৌশিক কঁচের গলায়। বললেন, ‘খানিকটা আশাহত হয়েছি ঠিকই। তবে হাল ছাড়ছি না।’ প্রতি তিনমাস অন্তর হবে এমন রক্তদান শিবির― ইতিমধ্যে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে মেদিনীপুর ছাত্রসমাজ।