ক্যানসার ও করোনা
দোয়েল দত্ত: সমগ্ৰ বিশ্বের তুলনায় করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্ৰে ভারতের চিত্ৰটা মোটেও আলাদা নয়৷ বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা৷ কিন্তু অনেক জরুরি পরিষেবা সময়মতো না মেলায় মুশকিলে পড়ছেন ক্যানসারের মতো জটিল ও মারণ রোগের রোগীরা৷ তার উপর কোভিড ১৯-এর একটা ভয় তো সবসময়ে আছেই৷ কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন কিংবা ক্যানসারের রোগীদের শরীরে যদি কোনওভাবে আক্রমণ হানে করোনা, তাহলে উপায় কী? সমস্ত জবাব দিলেন রুবি জেনারেল হাসপাতালের বিশিষ্ট ক্লিনিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট ডা. সোমনাথ সরকার৷ মুখোমুখি দোয়েল দত্ত৷
এখন চারপাশে করোনার যা বাড়বাড়ন্ত, সেক্ষেত্ৰে ক্যানসারের রোগীদেরও তো তা হতে পারে৷ তাহলে প্ৰাথমিকভাবে কী কী করা উচিত?
আমাদের চিকিৎসায় ক্যানসারের রোগীদের আমরা প্ৰথম থেকেই কোভিড ১৯-এর ভয়াবহতা বলে রাখি৷ মানে চিকিৎসা করাতে আসা রোগীদের কোভিড সম্পৰ্কে প্ৰাথমিক কাউন্সেলিং৷ ক্যানসার মূলত দুভাগে ভাগ করে থাকি আমরা-একটা ব্লাড ক্যানসার ও অন্য দলে আছে বাকি সমস্ত ক্যানসার৷ এইসময়ে কোনও ক্যানসার রোগীকে দেখে যদি করোনা হয়েছে মনে হয় তাহলে তাকে ভৰ্তি করিয়ে করোনা পরীক্ষা করানো হয়৷ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসলে একটা কেমো দেওয়ার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ আর যদি পজিটিভ আসে তাহলে আইসোলেশন ওয়াৰ্ডে করোনার চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়৷ যতক্ষণ না করোনা সেরে যাচ্ছে ততক্ষণ তাঁকে কোভিড সেন্টারেই থাকতে হবে৷
আসলে ক্যানসার রোগীদের এমনিতেই ইমিউনিটি কম থাকে, আর করোনা হলে তা আরও কমে যায়৷ এসময়ে কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি সব বন্ধ৷ আগে করোনা থেকে মুক্তি, তারপরে ক্যানসারের চিকিৎসা৷ তবে কিছু কিছু ক্ষেত্ৰে আমরা এসময়ে রোগীকে দেখে (করোনা হয়নি এমন) কেমোথেরাপির বদলে কনজারভেটিভ থেরাপি করি, মানে ওরাল কেমোথেরাপি৷
ক্যানসার রোগীদের করোনা হলে সেরে ওঠার সম্ভাবনা কতটা?
এটা সম্পূৰ্ণভাবে নিৰ্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের রোগ প্ৰতিরোধক ক্ষমতার উপরে৷ আগেই বলেছি ক্যানসার রোগীদের রোগ প্ৰতিরোধক ক্ষমতা এমনিতেই দুৰ্বল হয়৷ তার উপর করোনা হলে তো আর কথাই নেই৷ তবে যাদের ইমিউনিটি অপেক্ষাকৃত ভালো তাদের অনেকেই সুস্থ হয়ে ওঠেন বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ কিন্তু দেহের রোগ প্ৰতিরোধক ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে কিন্তু মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়৷
করোনা এবং লকডাউন৷ সমস্ত পরিস্থিতি মিলিয়ে অনেকেরই কেমোথেরাপি বন্ধ করতে হচ্ছে৷ কতদিন এটি বন্ধ করে থাকা যায়? এর কি কোনও বিকল্প ব্যবস্থা আছে?
অন্তত ৭-১০ দিন বন্ধ করে রাখা যায়৷ কিন্তু এখন মাঝে মাঝে এমনও হচ্ছে যে ২-৩ সপ্তাহ পৰ্যন্ত বন্ধ রাখতে হচ্ছে৷ কোনও কোনও ক্ষেত্ৰে রোগীকে কেমোথেরাপির ওরাল মেডিসিন বা আইভি (ইন্ট্ৰা ভেনাস, শিরার মধ্যে দিয়ে চ্যানেল করে কেমোর ওষুধ দেওয়া) দেওয়া হচ্ছে৷ আর অনেক রোগীই তো দূরে আছেন৷ সেক্ষেত্ৰে তাঁরা আসতে পারছেন না৷ তখন স্থানীয় নাৰ্সিংহোমের সঙ্গে কথা বলে সেখানেই তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷
বৰ্তমান সংকটে আরও একটা জিনিস যোগ হয়েছে তা হল ওষুধের সমস্যা৷ এমনকী ক্যানসারের মতো রোগের ওষুধও সবসময়ে রোগীর বাড়ির লোকজন পাচ্ছেন না৷ কয়েকদিন আগেই খবরে এসছিল মরফিনের আকাল হয়েছে৷ পরিস্থিতি যখন এরকম, কীভাবে তার মোকাবিলা করা হবে?
এক্ষেত্ৰে আমরা একটি বিশেষ ওষুধ ব্যবহার করি, যাকে বলা হয় ডারমাল প্যাচ৷ জিনিসটা অনেকটা ব্যান্ড এইডের মতো৷ এটি ত্বকে লাগিয়ে দেওয়া হয়৷ এর মধ্যে ওষুধ থাকে, যা ধীরে ধীরে ত্বকে শোষণ হয়ে যায়৷ আর মরফিন শুধু দিলে যতটা না কাজ হবে কোনও অ্যানালজেসিকের (ব্যথা কমানোর ওষুধ) সঙ্গে সেডেটিভ (ঘুমের ওষুধ) দিয়ে ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা করলে ভালো ফল মিলবে৷ তাই ওষুধ্ আকাল হলে রোগীর বাড়ির লোককে চিকিৎসকের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করতে হবে বিকল্প ওষুধ জানতে৷
একেই ক্যানসার রোগী, তার উপরে কোভিডের হানা৷ সব মিলিয়ে রোগী এবং তার বাড়ির লোকজন সকলেই তো প্ৰচণ্ড হতাশায় ভুগছেন৷ অবশ্যই৷ বাড়ির লোক হতাশ, অধৈৰ্য হয়ে যাচ্ছেন৷ আমাদের তখন রোগীর পাশাপাশি তাঁদেরও কাউন্সেলিং করতে হচ্ছে৷ কতগুলি বিষয় তাঁদের ধৈৰ্য ধরে বোঝাতে হবে–এই হতাশাজনক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করবেন না৷ আস্তে আস্তে এই পরিস্থিতি কেটে যাবে, শেষ হয়ে গেলে আবার জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে, চিকিৎসা হবে ইত্যাদি৷
কোনও ক্যানসারের রোগী যদি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকেন, তাহলে বাইরে থেকে কোনও লোক এসে রোগীর সঙ্গে দেখা করার আগে কোন কোন সতৰ্কতা নেবেন?
প্ৰথমেই বলব রোগীকে একটা আলাদা ঘর দিতে হবে, সঙ্গে অবশ্যই অ্যাটাচড বাথ৷ রোগীর সঙ্গে ইন্টার অ্যাকশন যতটা পারা যায় কম করাই ভালো৷ রোগী সহ বাড়ির সকলকে মাস্ক, গ্লাভস পরে থাকতে হবে৷ আর কেউ রোগীর ঘরে ঢোকার আগে এগুলি ছাড়া যাবেন না৷ পাশাপাশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ভালো করে ধুতে হবে৷ আর বাইরে থেকে এসে সরাসরি রোগীর ঘরে ঢুকবেন না৷ সমস্ত জামাকাপড় ডেটল জলে কেচে স্নান করে প্ৰয়োজনীয় সতৰ্কতা নিয়ে তবেই যদি খুব প্ৰয়োজন হয়, তাহলে যাবেন, নচেৎ নয়৷
ক্যানসারের রোগীদের কোভিডের কোন কোন লক্ষণ দেখলে বাড়ির লোক সতৰ্ক হবেন, কেননা কোভিডেরও তো নয়া অনেক লক্ষণ আসছে৷ সাধারণ লক্ষণ জ্বর, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, সৰ্দি, হাঁচি তো আছেই৷ এছাড়াও দেখতে হবে ডায়ারিয়া বা ত্বকে কোন র্যা শ বের হল কি না৷ ডায়ারিয়ার সঙ্গে জ্বর, মাথাব্যথা, গা বমি ভাব থাকলে হতে পারে এটা ক্যানসারজনিত ডায়ারিয়া৷ এক্ষেত্ৰে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) টেস্ট করাতে হবে৷ তবে কোভিডের জন্যও ডায়ারিয়া হতে পারে৷ তবে কোনটা কোভিডের জন্য হচ্ছে আর কোনটা ক্যানসারের পাৰ্শ্বপ্ৰতিক্রিয়া সেটা বাড়ির লোক পাৰ্থক্য করতে পারবেন না, কাজেই কোনও সমস্যা হলে যে চিকিৎসক চিকিৎসা করছেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ক্রুন৷
এসময়ে ক্যানসার রোগীদের ডায়েট কীরকম হওয়া উচিত?
বেশি করে ভিটামিন সি ডায়েটে রাখতে হবে, যেমন সাইট্ৰাস সমৃদ্ধ ফল, সঙ্গে হাই প্ৰোটিন আর হাই ফাইবারযুক্ত ডায়েট৷ আর এমন খাবার খেতে হবে যা হবে সহজপাচ্য৷ এক্ষেত্ৰে বাড়ির তৈরি খাবারই শ্ৰেয়৷ অনলাইনে পাওয়া গেলেও বাইরের খাবার এখন একদম খাবেন না৷
আর সাৰ্বিকভাবে শরীর-মন ভালো রাখতে কোনও পরামৰ্শ?
শরীর সাথ দিলে একটু এক্সারসাইজ করা, ঘরের মধ্যে, বাড়ির ছাদে হাঁটা৷ গান শোনা, বই পড়া, যাতে ম্যুড রিল্যাক্সড থাকে৷
যোগাযোগ : ৯৮৩০০৭১১৬৪