
স্বর্ণার্ক ঘোষ: সময়টা আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার কথা। আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তখন সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে পশ্চিম সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কবল থেকে। এশিয়া হোক কিংবা আফ্রিকা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় উঠছে নতুন ভোরের সূর্য। আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা আর ভোরের পাখির কলতান সেই নতুন সকালকে করে তুলেছে বড়ই রোমাঞ্চকর। তেমনই এক সকালের কথা। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স মেডিকেল কলেজের বছর ২২ এর এক যুবকের মাথা চেপে বসল এক অদ্ভুত শখ। শুধুমাত্র একটি বাইক নিয়ে আমেরিকার বুকে ভেসে বেড়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল ওই মেডিকেল ছাত্রটি। যেমনি বলা তেমনি কাজ, বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এমনই এক সকালে বেরিয়ে পড়লেন দীর্ঘকায় বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী যুবকটি।
আর্জেন্টিনা থেকে শুরু করে পেরু,চিলি বলিভিয়া , কলম্বিয়া হয় এসে পৌছলেন নিকারাগুয়া সীমান্তের একটি ছোট্ট গ্রামে। শুধুমাত্র সফর নয় এই দীর্ঘ সফরে তিনি লাতিন দেশের বহু ধর্ম-বর্ণের মানুষের সঙ্গে কেমন পরিচিত হয়েছিলেন তেমনি বিভিন্ন দেশের দুঃস্থ অসহায় মানুষের চিকিৎসার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন স্বেচ্ছায়। অশ্ব যক্ষা রোগীর চিকিৎসা থেকে শুরু করে শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টে তাদের পাশে থেকে লাতিন দেশের শ্রমিক পরিবারগুলোর এক প্রকার নিজের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলেন চিকিৎসক যুবকটি। মোটরসাইকেলে চেপে তার এই লাতিন আমেরিকার সফর পরবর্তীকালে হয়তো কিউবা বিপ্লবের ভিত রচনা করেছিল। যা বিখ্যাত চের ডায়েরি অথবা মোটরসাইকেল ডায়রিজ নামক গ্রন্থের মাধ্যমে আমরা এই কাহিনী জানতে পারি।
সফরকালীন একসময় পেরুতে মার্কিন পুঁজিবাদীদের প্রমোদ দেখে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ওই যুবক। ইউনাইটেড বানানা কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, কিংবা চিলির কয়লা খনিতে শ্রমিক মুক্তির সংগ্রাম পরবর্তীকালে জাগিয়ে তুলেছিল আমাজন উপত্যকাকে। এরপর কি বার বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর সান্নিধ্যে এসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব কেই এক ও অদ্বিতীয় পন্থা হিসেবে বেছে নেন ওই আর্জেন্টিনীয় চিকিৎসক ডক্টর চে আর্নেস্তো গুয়েভারা।
এরপর সিগারের ধোঁয়ায় মুমূর্ষু আমাজনের বুকে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেন তিনি। শোষণ কণ্ঠা নিরাশায় ডুবে থাকা লাতিন সমাজ একযোগে জ্বলে উঠেছিল মেডিকেল ছাত্রের আহ্বানে। মেডিকেল ছাত্র থেকে তিনি হয়ে উঠলেন সমগ্ৰ লাতিন দেশের বিপ্লবী নেতা। ডক্টর গুয়েভারা থেকে হয়ে উঠলেন কমান্দান্তে মেজর গুয়েভারা।
এরপর পিগ সাগর সংকট থেকে গেরিলা যুদ্ধ। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে মার্কিনপন্থী বাতিস্তা সরকারকে পরাস্ত করে কিউবায় ক্ষমতা দখল করলেন ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারা। রক্তাক্ত আখের ক্ষেতে ফুটে উঠল নতুন সবুজ ঘাস। কিউবায় প্রতিষ্ঠিত হল কমিউনিস্ট শাসন।
সাল ১৯৫৯, ক্ষমতা লাভের পর এবার কিউবাকে নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন প্রেসিডেন্ট কাস্ত্রো। তাই সে সময় সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো কিভাবে নিজেদের তৈরি করছে তা জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন কাস্ত্রোর মুখ্য উপদেষ্টা গুয়েভারাও। সেইমতো দেশের ইউরোপ আশিয়া আফ্রিকা দেশ সফরের পর তিনি ভারত সফরের আসতে প্রস্তুত হলেন। এলেন ভারত সফরে। জহরলালের ভারতের ছিলেন টানা দু’ সপ্তাহ। দেখলেন কথা বললেন এরপর ফিরে গিয়ে ভারত সম্পর্কে একটি স্পেশ্যাল রিপোর্ট তৈরিও করেছিলেন মেজর গুয়েভারা। প্রশংসার পাশাপাশি অনেক কিছুতেই দুঃখ হতাশা অনেক কিছুই স্থান পেয়েছিল বিপ্লবীর লেখা ওই রিপোর্টে।
সে বছর ৩০শে জুন ওয়েদার বিমান দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে ল্যান্ড করে। বেরিয়ে আসেন দীর্ঘকায় বিপ্লবী চে গুয়েভারা। চেকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন নেহেরু সরকারের প্রটোকল অফিসার ডিএস খোসলা। চের ওই ভারত সফরে সঙ্গী ছিলেন মাত্র চারজন একজন গণিতজ্ঞ একজন অর্থনীতিবিদ একজন রেডিও কমিউনিকেটর ও একজন দেহরক্ষী। তখন সদ্য গড়ে ওঠা দিল্লির প্রাসাদ প্রমোদ অশোকা হোটেলে রাখা হয়েছিল ওই বিপ্লবী নেতাকে।
পরদিন সকালে অর্থাৎ ১ জুলাই দিল্লীর তিনমূর্তি ভবনে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সঙ্গে বৈঠকে বসেন চে। সৌজন্য সাক্ষাৎ মেজাজ গল্প সবকিছুই হয় এরপর লাঞ্চের পর দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আর্থসামাজিক উন্নয়নে চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিউবার সংগ্রামের প্রতি নেহেরুর শ্রদ্ধা এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি নেহেরুর আন্তরিক ভালবাসা সবই পরবর্তীকালে ফুটে উঠেছিল সেই স্পেশ্যাল রিপোর্টে।
ভারতের পক্ষ থেকে সে সময় সে হাতে তুলে দাও একটি খুকরি সেই ভালোবাসার বিশ্বাসের নিদর্শন আজও বহন করে চলেছে। হাভানার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে গেলে সেই ভারত-কিউবা মিত্রতার সাক্ষী বহন করে চলা ওই উপহারটির নিদর্শন মেলে।
এরপর চের নেতৃত্বে ওই কিউবান প্রতিনিধিদলটি দিল্লি সংলগ্ন একাধিক শিল্পাঞ্চল গুলিও পরিদর্শন করে দেখেন। ঘুরে দেখেন বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও হস্তশিল্প কেন্দ্রগুলি। জান দিল্লি প্রসিদ্ধ শিল্পাঞ্চল ওখলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়াতেও। কথা বলেন শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা ক্ষুদ্র কুটির শিল্পী এবং শ্রমিকদের সঙ্গেও।
শুধু ক্ষুদ্র শিল্প নয় ভারত কিউবার মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক মজবুত করতে তিনি এরপর বৈঠক করেন তৎকালীন নেহেরু ক্যাবিনেটের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কে মেননের সঙ্গে। ভারতীয় সেনার আধিকারিকরা এবং কিউবা বিদ্রোহীদের ওই সামরিক বৈঠক আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়েছিল হোয়াইট হাউসকেও।
এরপর দ্বিপাক্ষিক আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য দেশের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এগ্রিকালচারাল লাবরাটরি ও প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বিদ্রোহী নেতা। গিয়েছিলেন ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরোটারি এবং লেদার কারখানাতেও। শুনেছিলেন শ্রমিকদের কথা।
দিল্লি সফরকালীন সময় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা অল ইন্ডিয়া রেডিও তাঁর বিশেষ সাক্ষাৎকার। সেই সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও সাংবাদিক কে পি ভানুমতির কমিউনিজম নিয়ে গুয়েভারা কে করা একটি প্রশ্ন যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল। “আপনি কমিউনিজমে বিশ্বাসী কিন্তু কমিউনিস্টরা বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখে না, কেন?” এই ছিল ভানুমতির সেদিন এর প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের জবাবে ইচ্ছে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন তিনি একজন সোশালিস্ট অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক তিনি কমিউনিস্ট নয়। সমাজতন্ত্র সমাজে সমানাধিকারে বিশ্বাস রাখে। সেই প্রসঙ্গে তিনি গান্ধীর অহিংস আন্দোলন কেও ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান হিসেবেও উল্লেখ করেছিলেন। উল্লেখ্য, গোটা সাক্ষাৎকার পর্বেই তাঁর হাতে জ্বলছিল চিরাচরিত হাভানা সিগার।
চিরকাল লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে নিজের জীবন অতিবাহিত করার পরও ভারতের স্বাধীনতা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ও সত্যাগ্রহের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা শোনা গিয়েছিল বিদ্রোহী নেতার কন্ঠে। যা থেকে তার বৃহৎ মানসিকতা এবং ভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে শ্রদ্ধা জানানোর নৈতিক গুণ সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায়।
“ভারতীয়রা কখনোই যুদ্ধ এবং হিংসায় বিশ্বাসী নয়, এমনকি যুদ্ধ-লড়াই শব্দটা তাদের মস্তিষ্কে কখনোই আসেনি। এমনকি যখন তাঁরা জাতির সবথেকে দুর্বিষহ পরিস্থিতি অর্থাৎ গত দেড়শ বছর ধরে যখন তারা ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম মধ্যে বিরাজমান ছিলেন”‘।
পরবর্তীকালে কিউবাতে ফিরে গিয়ে তাঁর স্পেশাল রিপোর্টে এই কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
দিল্লির পাশাপাশি তিনি হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশের একাধিক গ্রাম ঘুরে দেখেন কথা বলেন সেখানকার কৃষক ভূমিহারা কৃষক, শ্রমিকদের সঙ্গে। করে দেখেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিও। জানা যায়, বিদ্রোহী নেতাকে কাছে পেয়ে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিল সেখানকার স্থানীয় কৃষক শ্রমিকেরা। যদিও সে সময় ভারতীয় কৃষকদের শোচনীয় অবস্থা এবং শ্রমিকদের দুরাবস্থা নিয়ে চরম হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন গুয়েভারা। ভারতীয় কৃষকদের আর্থিক অবস্থা ফসলের দাম বাজার মূল্য যেমন ভাবিয়ে তুলেছিল চে কে তেমনি দেশের মজদুর শ্রেণীর অবস্থা দেখেও কেঁদেছিল বিপ্লবীর হৃদয়।
পরবর্তীকালে ঐ সমস্ত রিপোর্টের ভিত্তিতেই ভারত-কিউবার মধ্যে কৃষি, শ্রমিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক মহলের শ্রমিক সুরক্ষা নিয়ে একাধিক সহযোগিতামূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল।
এরপর দিল্লি সফর শেষে তিনি দুদিনের জন্য এসেছিলেন কলকাতাতেও। বাংলায় এসে তিনি সাক্ষাৎ করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। দুই চিকিৎসকের মধ্যে কথা হয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
তাঁর সফর পরবর্তীকালে বাংলায় বাম দলগুলিকে কতটা উৎসাহিত করেছিল সেটা অন্য বিষয় তবে তাকে দুহাত ভরে সেদিন স্বাগত জানিয়েছিল কলকাতাবাসী। এরপর কলকাতা থেকে ভারত সফর শেষ করে তিনি বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বার্মার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু ৮ সেপ্টেম্বর হঠাৎ প্রেসিডেন্ট কাস্ত্রোর অসুস্থতার খবর পেয়ে এশিয়া সফর অধরা রেখেই নিজের দেশে দ্রুত ফিরে যান মেজর গুয়েভারা।
পরবর্তীকালে চে গুয়েভারার তৈরি ভারত বিষয়ক স্পেশাল রিপোর্টে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে ভারত কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত। সেই সম্পর্কে পরবর্তীকালে বয়ে নিয়ে যান ফিদেল কাস্ত্রো এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
আন্তর্জাতিক মহলে নানা ইস্যু থেকে জাতিপুঞ্জের নানা বিষয়ে ভারতকে সমর্থনের জন্য সর্বদাই এগিয়ে এসেছে পিগ উপসাগরের ওই ছোট্ট দেশটি। দিল্লিতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ইন্দিরা গান্ধীকে কাস্ত্রোর আলিঙ্গন ভারত কিউবার দৃঢ় সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। যার নেপথ্যে ছিল গুয়েভারার লিখিত ওই স্পেশাল রিপোর্ট।
নব্বইয়ের আর্থিক সংকটের সময় প্রায় ১০ হাজার টন গম চাল কিউবাতে পাঠায় তৎকালীন ভারত সরকার। সেই ভারত প্রেরিত রুটিকে দ্য ব্রেড অব ইন্ডিয়া বলে আখ্যায়িত করেছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো। গুস্তাফের মত ঘূর্ণিঝড় বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবসময় কিউবার সঙ্গে থেকেছে ভারত। এবং আর্থিক ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ভারতকে আজ পর্যন্ত সহযোগিতা করে এসেছে হাভানা।
সময় বদলেছে, যুগ পাল্টেছে, বিশ্ব রাজনীতি দ্বিমেরুকরণ থেকে মেরুকরণ হয়েছে। ভেঙেছে বার্লিন ওয়াল, পতন হয়েছে সোভিয়েতের। কিন্তু দুর্যোগ হোক কিংবা মহামারী মিত্রতা বিশ্বাস ও পারস্পরিক সহযোগিতার আশ্বাসে আজও একই মোহনায় মিশছে পিগ উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের নীল জলরাশি। যার সূত্রপাত হয়েছিল সাত দশক আগে সেই বিদ্রোহী নেতার ভারত সফরের মধ্যে দিয়েই।