‘চিন একটা অন্ধকূপ, আমাদের বাড়ি এখন টর্চার সেল’

লস অ্যাঞ্জেলেস, (সংবাদ সংস্থা): জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরেদের উপর চিন সরকার কিভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছে বছরের পর বছর, দ্য লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকার সেই চিত্র তুলে ধরেছেন চার পাকিস্তানি। যারা উইঘুর সম্প্রদায়ে বিয়ে করেছিলেন এবং নির্যাতিতদের একজন।
সিকান্দার হায়াত একজন ব্যবসায়ী। নিজ ছেলেকে নিয়ে গত রমজান মাসে চিন থেকে জন্মস্থান পাকিস্তানে গিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তান তিন সপ্তাহ কাটানোর পর তার কাছে খবর আসে, চিনের জিনজিয়াং প্রদেশে থাকা সিকান্দারের স্ত্রীকে আটক করা হয়েছে। কেননা তার স্ত্রী উইঘুর সম্প্রদায়ের। এরপর ছেলে আরাফাতকে নিয়ে ফেরার জন্য চিনের সীমান্তে যান সিকান্দার। সেখানে থাকা চিনা পুলিশ মায়ের মত ছেলে আরাফাতকেও আটক করে। পুলিশ জানায়, পাকিস্তানে তারা কী করেছে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।এক সপ্তাহের মধ্যে ছেলেকে ফেরত পাবেন বলে সিকান্দারকে সেসময় জানিয়েছিল পুলিশ। এ ঘটনার পর প্রায় দুই বছর সময় পেরিয়ে যায়। কিন্তু ছেলের দেখা মেলে না সিকান্দারের।
সিকান্দার বলেন, কারাগারের চেয়েও ভয়ংকর জায়গায় নিজের প্রিয়জনদের থাকার খবর খুব কষ্টের। স্ত্রী ও ছেলেকে আটকের পর চিন দুই বছর আমার ভিসা দেয়নি। আমাকে না জানিয়ে আমার ৭ বছর ও ১২ বছর বয়সী দুই মেয়েকে এতিমখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি পাকিস্তান ও চিন উভয় দেশের কাছেই স্ত্রী ও সন্তানের খবর চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তখন চিনের কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ক্যাম্পে তার ছেলে ‘পড়াশোনা’ করছে।
বরাবরই বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছে, জিনজিয়াংয়ে প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুর ও অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনকে ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন চালাচ্ছে চিন সরকার। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিবেদন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, ‘শিক্ষা শিবির’ নামক ক্যাম্পে উইঘুরদের আটকে রেখে তাদের চিনা ম্যান্ডারিন ভাষা শেখানো হচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসার কথা বলা এবং তাদের সঠিক আচরণ পরিচালনার নিয়মগুলো কঠোরভাবে মনে রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা করতে অথবা সেই ধর্ম পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ অভ্যাসগুলোর অংশ হিসেবে চিন সরকার সাংঘর্ষিকভাবে জিনজিয়াংয়ের উইঘুর সংস্কৃতি ও জাতিগত সত্তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।
তবে ক্যাম্পের ভেতরে যারা ছিলেন তারা বলছেন ভিন্ন কথা। দক্ষিণ জিনজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা মোহাম্মদ ২০০০ সাল থেকে পাকিস্তানে ব্যবসা করতেন। তিনি জানান, তাকে ক্যাম্পে সাত মাস আটকে রাখা হয়। ২০১৮ সালে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় তাকে আটক করা হয়। এরপর ক্যাম্পে একটি কক্ষে ৩৫ জনের সঙ্গে তাকেও হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়। তিনি জানান, প্রতিদিন ভোর ৪টায় তাদের ডেকে তোলা হত। এরপর চিনা কমিউনিস্ট পার্টির বিষয়ে তাদের জ্ঞান দেওয়া হতো। সেখানে আমাদের বলা হতো, কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের খাবার দিচ্ছে এবং পার্টি ছাড়া উইঘুরদের কোনো অস্তিত্ব নেই। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি না থাকলে তাদের না খেয়ে মরতে হবে।
তারপরে, পার্টি এবং চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রশংসা করে গান গাইতে বাধ্য করা হতো। এরপর ব্যায়াম করতে হতো। খাবার হিসাবে গরম জল এবং এক টুকরো রুটি দেওয়া হতো খেতে। এরপর পাঁচ ঘণ্টা চিনা-ভাষা শেখানো হতো।
পাকিস্তান থেকে তার স্ত্রী ও সন্তানকে জিনজিয়াংয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার শর্তে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাকে চিনের হয়ে তথ্যদাতার কাজ করার জন্য বলা হয়।
আরও পড়ুন:হাইকোর্টে শূন্যপদে নিয়োগে ট্রানজেন্ডারদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া নিয়ে মামলা হাইকোর্টে
মোহাম্মদ জানান, ‘আমি আর চিনে ফিরে যাব না। চিন একটা অন্ধকূপ। আমাদের বাড়ি এখন টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। সেখানে ফিরে গেলে আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য মৃত্যু অনিবার্য।’
দ্য লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস জানিয়েছে, সাক্ষাৎকার দেওয়ার কিছুদিন পরে মোহাম্মদ পাকিস্তান ছেড়ে চলে গেছেন। তার পরিবারের সদস্যদের ভাগ্যে কী হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে,
উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রতি দমন-পীড়নের ঘটনার বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব সোচ্চার হলেও নীরব রয়েছে মুসলিম দেশ পাকিস্তান।পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রতি নির্যাতনের বিষয়ে বেশি কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন।