
যুগশঙ্খ ডিজিটাল ডেস্ক: সময়টা ১৯৯৬৷ দেশে রাজনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি৷ স্বয়ং রাজীব গান্ধির প্রস্তাব৷ এমন সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া হওয়ায় আফসোস প্রকাশ করেছিলেন শুধুমাত্র দুটো শব্দে- ঐতিহাসিক ভুল৷ আজও ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছেন তিনি ৷ কমরেড জ্যোতি বসু ৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আজ ১০৭ তম জন্মদিন।
প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার অভিমান থাকলেও সংগঠনের জন্য সারা জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন তিনি ৷ সরকারের আসার আগে বিধানসভার সদস্য হিসেবে মাসের রোজগার ছিল মাত্র আড়াইশো টাকা ৷ পুরো টাকাটাই যেত পার্টি ফাণ্ডে ৷ এদিকে বসু পরিবারে টানাটানির সংসারে রোজকার ডাল-ভাত যোগানোই ছিল কষ্টকর ৷ পরে অবশ্য বিরোধী দলনেতা হওয়ার পর সেই মাইনে ২৫০ থেকে বেড়ে ৭৫০ টাকা হওয়ার পরও সংসারের জন্য বরাদ্দ বাড়েনি কিন্তু বেড়ে গিয়েছিল পার্টি ফাণ্ডের বরাদ্দ ৷ সংসার চালাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তেন স্ত্রী কমলা বসু ৷ সিদ্ধার্থশঙ্কর সহ জ্যোতি বাবুর বন্ধুস্থানীয় নেতাদের কাছে অনুযোগও করতেন তিনি ৷
জ্যোতি বসু আর তাঁর ঠিক আগে যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সেই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এতটাই ছিল, যার সঙ্গে এখনকার মুলায়ম সিং যাদব আর মায়াবতীর দ্বন্দ্বের তুলনা করা চলে। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁদের দুজনের মধ্যে ছিল ততটাই সখ্যতা। সেই নৈকট্য শব্দে বর্ণনা করা কঠিন। একবার চন্দননগর থেকে কলকাতায় আসার সময়ে জ্যোতি বসু আর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে কয়েকজন অল্পবয়সী মেয়ে ঘিরে ধরেছিল। জ্যোতি বাবু সেই সময়ে রীতিমতো স্টার নেতা। তাই অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই মেয়েরা জ্যোতি বাবুর হাতের লেখায় ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারে নি। তারা চাইছিল সইয়ের সঙ্গেই তিনি যদি কয়েকটা লাইনও লিখে দেন। জ্যোতি বসু আর কিছু লিখতে চান নি, শুধু সই করে দিয়েছিলেন। গাড়িতে ফিরে আসার পরে সিদ্ধার্থশঙ্কর মজা করে বলেছিলেন, “এত সুন্দরী মেয়েগুলোকে তুমি এক কথায় মানা করে দিলে? রবীন্দ্রনাথের কোনও লেখা থেকে একটা দুটো লাইন লিখে দিতে পারতে।”জ্যোতি বসু জবাব দিয়েছিলেন, “জানলে তো লিখব।”
বাংলাদেশ যুদ্ধের কিছুদিন আগে সিদ্ধার্থ শঙ্কর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে জ্যোতি বসুর একটা গোপন বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন। কেউ যাতে জানতে না পারে, সেই জন্য রাত এগারোটায় বৈঠকের সময় ঠিক হয়েছিল। নজর এড়াতে নিজের স্ত্রী মালা রায়ের ফিয়াট গাড়িতে জ্যোতি বসুকে বসিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর বাড়ি ১ নম্বর সফদরজং রোডে নিয়ে গিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। ঘন্টাখানেকের ওই বৈঠকের পরে বাইরে বেরিয়ে রাস্তা গুলিয়ে ফেলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। অনেকক্ষণ ধরে দিল্লির রাস্তায় চক্কর কাটার পরে তিনি ঠিক করেন কোনও একটা থানায় গিয়ে সাহায্য চাওয়া উচিত। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, “তুমি কি বোকা নাকি! গোটা দুনিয়াকে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানাতে চাও যে আমি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম?” ঘটনাচক্রে মি. রায় ঠিক রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলেন কিছুক্ষণ পরে, তাই আর সে যাত্রায় থানায় যাওয়ার দরকার পড়ে নি।
আরও পড়ুন: লর্ডসের ব্যালকনি থেকে বিসিসিআইয়ের মসনদ, টিম ইন্ডিয়ার রূপকার,মহারাজা তোমারে সেলাম
রাজনৈতিক বিরোধ থাকার স্বত্ত্বেও জ্যোতি বসু কংগ্রেসের আরেক বড় নেতা এ বি এ গণি খান চৌধুরীকে নিজের পরিবারের সদস্য বলেই মনে করতেন। সবাই যখন মি. খান চৌধুরীকে ‘বরকতদা’ বলে ডাকত, জ্যোতি বাবু তাঁকে ‘সাহেব’ বলেই সম্বোধন করতেন। মি. খানচৌধুরীর বোন প্রতি দুসপ্তাহে একবার করে বিরিয়ানি রান্না করে পাঠাতেন জ্যোতি বাবুকে। নিয়মের ব্যতিক্রম হলে জ্যোতি বসু ফোন করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেন, “কী পাঠাওনি কেন?”
এক শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। লেখাপড়া করেছেন কলকাতার অভিজাত স্কুল ও কলেজে। ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন । কলকাতার পড়াশোনা শেষে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন ল’ পড়তে। বিলাত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসলেন, কিন্তু ব্যারিস্টারী করলেন না। তিনি হলেন কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী।কমিউনিস্ট হয়ে যাওয়া ব্যরিস্টার জ্যোতি বসু ট্রামে বাসে রাস্তায় পার্টির পত্রিকা বিক্রি করেছেন, রেলওয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে নানা জায়গায় ঘুরেছেন, শ্রমিক বস্তিতে থেকেছেন। এইভাবে তিনি নিজেকে শ্রেণীচ্যুত করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই এক টানা ৩৪ বছর উড়েছে বামেদের পতাকা ৷ ভারতের দীর্ঘতম মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু ৷ কমিউনিস্ট হয়ে যাওয়া ব্যরিস্টার জ্যোতি বসু ট্রামে বাসে রাস্তায় পার্টির পত্রিকা বিক্রি করেছেন, রেলওয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে নানা জায়গায় ঘুরেছেন, শ্রমিক বস্তিতে থেকেছেন। এইভাবে তিনি নিজেকে শ্রেণীচ্যুত করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই এক টানা ৩৪ বছর উড়েছে বামেদের পতাকা ৷ ভারতের দীর্ঘতম মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু ৷
আরও পড়ুন: করোনা নাশক আবিস্কারে বিশ্ববাসীকে চমক দিল এই কৃষকের সন্তান
১৯৭৭ সাল থেকে টানা ২৪ বছর জ্যোতিবসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বারবার নির্বাচনে তাঁর দল বিজয়ী হয়েছিল। এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি আছে বলে আমার মনে হয় জানা নেই। প্রশাসক হিসাবে জ্যোতিবসু আসাধারণ দক্ষতার ও প্রখর বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। ২৪ বছর মুখ্যমন্ত্রীত্ব করার পর তিনি ঐ দায়িত্বটি তুলে দেন তাঁরই দলের কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যরে হাতে। এই যে বিরাট সাফল্য তার পেছনে জ্যোতি বসুর ব্যক্তিগত যোগ্যতাও যেমন ছিল, তেমনি ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও আদর্শনিষ্ঠ পার্টির ভূমিকা। এই সময়কালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের ক্ষেত্রে তিনি যা করছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভূমি সংস্কার, বর্গা অপারেশন, শিল্পায়ন এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। ফলে গরিব জনগণ কিছুটা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল। গরীব সীমিত আকারে হলেও গরীব জনগণের যে ক্ষমতায়নের কাজটি করতে পেরেছিলেন সেটাই ছিল তাঁর দলের এবং তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার মূল কারণ। আরও উল্লেখ্য যে পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় জাতপাত ও সা¤প্রদায়িকতার বিষয়টি খুবই কম ছিল।
জ্যোতি বসুর বাংলাদেশের প্রতি দুর্বলতা ছিল সবসময়। তিনি ছিলেন আসলেই বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৯৬ সালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মূলত গঙ্গার পানি বন্টন বিষয়ে আলোচনা করতে, যদিও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলেন না। তখনই লক্ষ্য করা গেছে যে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করার ব্যাপারে তাঁর ছিল আন্তরিক প্রচেষ্টা। সম্ভবতঃ নাড়ির টানে তাঁর এই বিশেষ দুর্বলতা ছিল।
জ্যোতি বসু ব্যক্তি হিসাবে ছিলেন সন্দেহাতীতভাবে সৎ ও আর্দশনিষ্ঠ। তাঁর মধ্যে ছিল এক দরদী মন। মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন অতি উঁচু এবং কঠিন বিষয়কে সহজে ব্যাখ্যা করার অসাধারণ যোগ্যতা তাঁর ছিল। তাঁর মাঠের বক্তৃতাও আমি শুনেছি। আমাদের দেশে যে ধরনের জ্বালাময়ী বা আবেগপ্রবণ বক্তৃতা করার অথবা নাটকীয় ঢং এ বক্তৃতা করার প্রবণতা আছে অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের মধ্যে, জ্যোতি বসুর বক্তৃতায় তা পাওয়া যাবে না। তাঁর বক্তৃতা শুনলে মনে হয় যেন তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে সহজভাবে আলাপ করছেন। তবে তাঁর বক্তৃতায় এক ভিন্ন ধরনের সম্মোহনী ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।