করোনা আটকে দিয়েছে ‘বেড়ু বেড়ু’ বাঙালির বেড়িয়ে আসা
ভাস্করব্রত পতি, তমলুক : এবছর আর বাঙালির ‘বেড়ু বেড়ু’ হবেনা। করোনা পরিস্থিতি অন্তত সেরকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে। গরমের ছুটির দফারফা। সামনেই পুজোর ছুটি। কিন্তু এখন বুকিংয়ের কোনও উপায়ই নেই। লক ডাউন ওঠার নামগন্ধই নেই। এরকম পরিস্থিতি এখনও ক’দিন চলবে কে জানে! ফলে যেসব বানিজ্যিক এবং শখের অবানিজ্যিক ট্যুর কোম্পানিগুলো বেড়ানোপ্রিয় বাঙালিদের ইতিউতি ঘোরাঘুরি করতে নিয়ে যেতো, তাঁদের এখন দমবন্ধ কর অবস্থা। এককথায় ‘লবেজান’ হালচাল! এই ভয়ের আবহে গৃহবন্দী বাঙালি কিন্তু মোটেও রিস্ক নেবে না কুলু, মানালি, রাজস্থান, আন্দামান কিংবা নেহাত দার্জিলিং, পুরি, নেতারহাট যাওয়ার ক্ষেত্রে। বিদেশ বিভুঁইয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই এখন। আর বাঙালি হয়তো নাকে মাস্ক পরে লাউচিংড়ির সুগন্ধ ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু বেড়াতে গিয়ে রডোডেনড্রন কিংবা টিউলিপের সুঘ্রান আটকে রাখতে হবে নাকে মুখে ঢাকা মাস্কে — নৈব নৈব চ! এটা মেনে নেবেনা ‘বেড়ু বেড়ু বাঙালি’।
ইতিমধ্যে ভারত সরকার বন্ধ করে দিয়েছে অমরনাথ যাত্রা। চারধাম যাত্রাও থমকে গিয়েছে অবশেষে। গত দুমাসে সব ধরনের ভ্রমণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে ভ্রমণ সংস্থাগুলো। আগামী দুমাসেও সব বন্ধ। এখন যা পরিস্থিতি, কবে ফের তা চালু হবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে। কেউই হলফ করে বলতে পারছেনা কিছুই। ট্রেন ও প্লেন চলাচল বন্ধ। কোনো বুকিংই হচ্ছেনা। হলেও বেড়াতে যাওয়ার পর্যটক মেলার সম্ভাবনা কোথায়? পুজোর সময় যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কে বলতে পারে! তাই কবে যে বাঙালি আবার মনের সুখে গাইবে – ‘এই শহর থেকে আরো অনেক দূরে, চলো কোথাও চলে যাই …..’?
আগামী ১৬ ই মে থেকে চারধাম যাওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন এগরার আটজন শিক্ষক। গরমের ছুটিটা কাজে লাগান প্রতি বছর এভাবেই। কিন্তু হোলোনা যাওয়া। তাঁদেরই একজন দীপ্তিমান পানিগ্রাহী জানান, এখন নিজেরা যেতাম। পূজোর ছুটিতে তিনটি পরিবার নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দিল্লি সহ সংলগ্ন এলাকায়। সব বানচাল। চলতি বছরে হয়তো বাড়ির বাইরেই পা দেওয়ার সুযোগটুকুও মিলবেনা মনে হয়। একই বক্তব্য ভোগপুরের মোহিত কুমার মিশ্র ও সঙ্গীতা মিশ্রের। ছেলের মাধ্যমিকের পর একটু বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন পরিবার সহ। এখন গৃহবন্দী হয়ে ঘরে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা হতেই ডলারের তুলনায় বাড়ল টাকার দাম
সারা বছর বিভিন্ন যায়গায় লোকজনকে খুব কম অর্থের বিনিময়ে বেড়াতে নিয়ে যায় কোলাঘাটের ‘বলাকা ভ্রমণ সংস্থা’। এখন হাত গুটিয়ে বসে আছেন এর কর্ণধার অসীম দাস। তিনি জানান, এই মুহূর্তে সব ধরনের ট্যুর বাতিল হয়ে যাওয়ার দরুন ট্রেন, বাস, বিমান, হোটেল, গাড়ি বাবদ প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা সরকারের ঘরে পড়ে রয়েছে। বেশিরভাগ লোকজনের কাছে অ্যডভান্স নেওয়া হয়েছিল। আদৌ তা ফেরত দেওয়া সম্ভব কিনা বলতে পারছেননা। মূলতঃ ট্যুর শুরুর চার মাস আগে থেকেই সব বুকিং করতে হয়। সেই মোতাবেক আগামী জুলাই আগষ্ট পর্যন্ত অন্ততঃ ৮ খানা ট্যুর প্রোগ্রাম রেডি হয়ে গিয়েছিলো।
তাঁদেরই উদ্যোগে এবার অক্ষয় তৃতীয়াতে কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ যাওয়ার কথা ছিল ৪০ জনের। সব ব্যবস্থা পাকা ছিলো। ১৭ এপ্রিল বিমানে লেহ লাদাখ যেতো ৮ জন। ৩-৪ মে অমৃতসর ও ডালহৌসি যাওয়াও ক্যানসিল করতে হয়েছে লক ডাউনের জন্য। চারধাম যাত্রাতেও বন্দোবস্ত পাকা করা ছিলো বহু পর্যটকের। অসীম দাস জানান, সকলকেই এবার টাকা ফেরত দিতে হবে। শুধু অমরনাথ যাত্রার জন্য ১৫০ জন ঠিক ছিলো। কোথাও যাওয়া যাবে না আর। চূড়ান্ত আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি তিনি। তাঁর মতো পশ্চিমবঙ্গের সব ছোটবড়ো ট্যুর অপারেটরদেরই একই হাল। ধীরে ধীরে এই পর্যটন শিল্প একটা যথার্থ ‘শিল্প’তে পরিনত হয়েছিল। ‘ঘরমুখো’ বাঙালি ক্রমশঃ বিশ্বদর্শনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলো। কোরোনা আসলে সেই শিল্পের কোমরটাই ভেঙে দিয়েছে। বিরাট একটা আঘাত এই শিল্পের সাথে যুক্ত লোকজনের ওপর আছড়ে পড়েছে বলা যায়।
যেসব হোটেল বুকিং হয়েছিল, তাঁরা তো টাকা ফেরত দেবেনা জানিয়ে দিয়েছে। পরে ঐ টাকা অ্যডযাস্ট করে নেওয়া হবে। কিন্তু কবে আবার শুরু হবে ট্যুর? কেউ জানেনা তা। অসীমবাবুর কথায়, বেড়াতে যাওয়াটা সম্পূর্ণ আনন্দের ব্যাপার। মনের মধ্যে যদি সবসময়ই মৃত্যুভয় বিরাজ করে, তবে কে আর সাধ করে বেড়াতে যাবে? আপাতত বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর বরাভয় ছড়িয়ে পড়েছে। এ থেকে মুক্তি না পেলে মানুষ ঘর ছেড়ে বেরুবেনা। ফলে ততদিন এই পর্যটন শিল্প কোনো ভাবেই চাঙ্গা হবেনা এটা নিশ্চিত।