
রবীন্দ্র কিশোর সিনহা: নীতিন গডকরি নিজেই বলেছেন যে রাস্তার দুর্বল নকশা তৈরি করাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার এই মন্তব্য থেকে সহজেই অনুমেয় যে আমাদের এখানে এখনও রাস্তাগুলির নকশা এবং নির্মাণে প্রচুর গাফিলতি রয়েছে। গডকরি নিজে একজন সক্রিয় ও প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী। নিজের কর্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেন তিনি। সৎ ও সফল আধিকারিকদের পুরস্কৃত করার ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা তৎপর। দুর্বল আধিকারিকদের শাস্তি দিতে তিনি মোটেও পিছপা হন না। অতএব, তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণের বিষয়ে যা-বলছেন, তা অবশ্যই তথ্যের ভিত্তিতে বলছেন, তাই তাঁর কথাটি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত।
খারাপ রাস্তা ও পথদুর্ঘটনা
খারাপ নকশার রাস্তা এবং তার উপর হওয়া পথদুর্ঘটনা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্বব্যাপী মোট সড়ক দুর্ঘটনার ১১ শতাংশ ভারতে হয়। ভারতে প্রতি বছর পাঁচ লক্ষ সড়ক দুর্ঘটনায় আড়াই লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। ছয় লাখ মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। আমাদের সড়ক এবং জাতীয় সড়কগুলি যাতে সুরক্ষিত থাকে সেই জন্য দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছেন নীতিন গডকরি। তবে এই কাজটি রাস্তাগুলির যারা নকশা করছে, নির্মাণ করছে এবং যাদের দায়িত্ব পরিচালন করা তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। ভেবে দেখুন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজেশ পাইলট, দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সাহেব সিং ভার্মা এবং বিখ্যাত অভিনেতা যশপাল ভট্টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রতি বছর, লক্ষ লক্ষ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে পড়ে।
পথ দুর্ঘটনার অনেকগুলো কারণ থাকে। এরমধ্যে ৬৬ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ দ্রুত গতিতে বাহন চালানোর জন্য। ফলে এর ওপর নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। দ্রুতগতির গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া একান্তভাবে বাঞ্ছনীয় এবং ন্যায়সঙ্গত। এ নিয়ে কোনও রকমের দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না। ছোট শহরের পাশাপাশি খোদ রাজধানী দিল্লির রাজপথে এমন অনেক গাড়ি ও অন্যান্য যান রয়েছে যেগুলি লাগাম ছাড়া গতি নিয়ে চলতে থাকে। গাড়ি চালানোর থেকে বেশি এদের লক্ষ্য থাকে অকারণে ওভারটেক করা। ফলে পথদুর্ঘটনা বেড়ে যায়।
আমাদের প্রধান সড়ক এবং জাতীয় সড়কগুলির মানোন্নয়ন যে হয়নি দুঃখের বিষয় তা কেউ মানতে চায় না। এটাও সত্যি কথা যে সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বানানো পর্যন্ত প্রতিটা ক্ষেত্রেই লুটপাট হয়। ছোট শহর থেকে শুরু করে মহানগরের রাজপথ কোনটাই সঠিক পদ্ধতিতে নির্মিত হয় না। ফলস্বরূপ, একটা প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তার কঙ্কালসার অবস্থা বেরিয়ে আসে। এরপরে নতুন রাস্তা তৈরি হতে দীর্ঘ সময় লাগে। নতুন রাস্তা নির্মাণের পুরানো ভুলগুলিও সংশোধন করা হয় না। এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
নয়াদিল্লির ধাঁচে রাস্তা তৈরি করা উচিত
প্রশ্ন হচ্ছে পুরো দেশের রাস্তাঘাটের মান কবে রাজধানী দিল্লির রাস্তার মতো হবে? রাজধানী দিল্লির রাস্তা সবদিক থেকেই বিশ্বমানের। আপনি যদি রাজধানীতে থাকেন তবে অবশ্যই জানবেন যে নয়াদিল্লির রাস্তাগুলি লন্ডন, প্যারিস বা নিউ ইয়র্কের রাস্তার মতোই দুর্দান্ত। তবে এরপরেও অনেক চালক যারা যানবাহন চালান তাদের গাড়ি চালানোর কোনও শালীনতা নেই। তারা প্রকাশ্যে ট্র্যাফিক বিধি লঙ্ঘন করে। লক্ষাধিক টাকার গাড়ি চালকরা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নতুন নজির গড়ে চলেছে। ট্র্যাফিক পুলিশ যখন তাদের ধরে ফেলেন, তখন তারা নির্লজ্জভাবে নত হয়ে ক্ষমা চাইতে থাকে। এখন এটাও জেনে নেওয়া যাক কে প্রথমে নয়াদিল্লির সেরা রাস্তা তৈরি করেছিল? সেই ব্যক্তির নাম ছিল সরদার নারায়ণ সিংহ। তিনি দিল্লির সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা তৈরি করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে রাজপথ এবং জনপথ। ১৯৩১ কিছু আগে এগুলো তৈরি হয়েছিল। এই নতুন রাস্তাগুলি দেশের নতুন রাজধানী নয়াদিল্লির উদ্বোধনের আগে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। সরদার নারায়ণ সিং এই রাস্তাগুলি প্রস্তুত করার বরাত পেয়েছিলেন। এখন নারায়ণ সিংয়ের মত ঠিকাদাররা কোথায়! তবে গডকরিজি দেশের রাস্তা উন্নত করতে সক্ষম হবেন।
নয়াদিল্লির প্রধান স্থপতিকার এডউইন লুটিয়েনস নারায়ণ সিং এর সঙ্গে নয়াদিল্লির রাস্তা প্রস্তুত করার জন্য একটি চুক্তি করেছিলেন। নারায়ণ সিং রাজস্থান থেকে রাস্তা তৈরির জন্য শ্রমিক নিয়ে এসেছিল। এখন রাজধানী এবং দেশের প্রধান শহরগুলির রাস্তাগুলি বিটুমিনাস প্রযুক্তিতে নির্মিত হয়। বিটুমিনাস প্রযুক্তি প্রবর্তনের আগে, ২৬শে জানুয়ারি ট্যাঙ্কগুলি চালুর কারণে রাজপথের অবনতি ঘটেছিল। তবে এখন তা হয় না। এটির ট্র্যাক রেকর্ডটি এখনও অবধি দুর্দান্ত। বিশেষ বিষয় হল এই রাস্তাটি সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। এই সড়ক তৈরির প্রযুক্তি সেন্টার রোড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিআরআরআই) এবং ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেস (আইআরসি) এর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন।
সড়ক নির্মাণের আগে এটা দেখে নিতে হবে সেখানকার জলবায়ু কেমন। ভূগর্ভস্থ জলের স্তর কেমন এবং সেখানে পয় প্রণালী কি পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছে। এইসব বিষয়গুলি খতিয়ে দেখে সড়ক নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে এগুলো দেখা হয় না। সেই কারণে আমাদের এখানকার সড়ক বেশি দিন পর্যন্ত টেকে না। সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকার যেহেতু বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করে সেহেতু এতে দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে যায়। সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে যারা যুক্ত হয় তারাই সরকারের বরাদ্দ অর্থ নিজের পকেটের নিতে তৎপর হয়। এর মধ্যে রয়েছে সড়ক নির্মাণ কোম্পানি, ঠিকাদার, সরকারিকর্মী। এই ঘুঘুর বাসা ভাঙ্গা একান্ত প্রয়োজন। কারণ এদের খেলা দীর্ঘ সময় ধরে চলে এসেছে। এদের লোভের জন্য প্রতি বছর হাজারো নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। অবিলম্বে এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রয়োজন উন্নত মানের এবং টেকসই সড়ক। দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হচ্ছে সড়ক। মনে রাখতে হবে ভাল সড়কের জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মহান ও সুন্দর হতে পেরেছে।