বর্ষায় আমন ধানের চাষ

নিজস্ব প্রতিনিধি: ভারতবর্ষে ধানের সর্বাধিক ফলন হয় আমাদের পশ্চিবঙ্গে। তাছাড়া আছে অসম এবং ওড়িশা| পঞ্জাবেও কিছু ধান হয়। আবার পঞ্জাবে গমের উৎপাদন ভারতবর্ষের নিরিখে সর্বাধিক। পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের মধ্যে ধানের উৎপাদন সব থেকে বেশি। ভারতের শতকরা ৭০ জন মানুষের কাছে কৃষিই প্রধান জীবিকা। দেশের জাতীয় আয়ের প্রায় ৫০ শতাংস কৃষি থেকেই আসে।
ধান চাষ বছরে তিনবার হয়। প্রথমে ‘আউষ’ এরপর ‘আমন’, তারপরে রবি। এখন যেমন আমন চাষ শুরু হয়ে গেছে। আমফানের পরে কিছু ধান গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু বৃষ্টি চলছে, সেহেতু সেই জায়গাগুলোতে আবার ধান গাছ লাগিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ ক্ষতিওত হয়নি। সাধারণত আমন ধান বর্ষার প্রারম্ভে শুরু হয়। আমন ধানের জন্য আদর্শ জমি হচ্ছে মাঝারি নীচু অথবা একদম নীচু জমি। যে কোনও জমিতেই এই ধান চাষ করা যায়। তবে এঁটেল, দোঁ-আশ মাটিতে ফলন ভালো হয়। সামান্য অম্ল থেকে আরম্ভ করে ক্ষারযুক্ত জমিতে চাষ করলে ভালো হয়।
আরও পড়ুন: ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’…খুঁনসুটি করার সময়ে ‘পালিত’ সিংহদের হাতেই মরতে হল আশ্রয়দাতাকে
সব থেকে মজার ব্যাপার হল অন্য যে কোনও শষ্য লবণাক্ত জমিতে চাষ করা খুব সহজ নয়। আমন কিন্তু এর বিপরীত। তা লবণাক্ত জমিতেও চাষ করা যায়। আরও ভালো হয় যদি কাদা জমিতে চাষ করা যায়। এখন না হয় প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু যদি বৃষ্টি পিছিয়ে যায় তবে জমিকে কাদান করে চাষ করুন।
আরও পড়ুন: এবছর আইপিএল খেলবেন না রায়না, ফের বড় ধাক্কা সিএসকে শিবিরে
বর্ষা শুরু হওযার সঙ্গে সঙ্গে হালকা ভাবে লাঙল চালিয়ে বেশ ভালো পরিমানে জৈব সার প্রয়োগ করুন। বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে এরপরে বীজ বুনুন। কাদান জমিতে ধান রোপন করলে আগাছা কম হয়। নরম কাদায় চারা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়। আমন ধানের তিনরকম উচ্চফলনশীল বীজ এখন পাওয়া যায়। আই. আর ৩৬ উচ্চফলনশীল হলেও এখন খুব একটা ব্যবহার হয় না। এম. টি. ইউ-৭০২৯ এবং এ. আর-৬৪ এগুলো এখন খুবই ভালো ফলন দেয়। সার প্রয়োগ- আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ খুবই প্রয়োজন। যেন নাইেট্রাজন প্রয়োগ জরুরী। তাতে গাছের সবুজ ভাবটা বেশ বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক কারণে তা সম্ভব না হলে সবুজ সার বা গোবর সার প্রয়োগ করুন।
সরকার থেকে বিনামূল্যে কোন সারের কতটা ঘাটতি আছে, তা জেনে নেওয়া যায়। ওঁরাই আপনাকে জানিযে দেবে| অতঃপর কৃষি আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিতে পারবেন যে কোন জমিতে কতটা নাইেট্রাজেন, পটাশ বা ফসফরাস প্রয়োজন। তবে নাইেট্রাজেন প্রয়োগের ব্যাপারে খুব সাবধান। বরং রোপন করার পূর্বে ও পরে সব মিলিয়ে অল্প অল্প করে নাইেট্রাজেন প্রয়োগ করতে হবে। নাইেট্রাজেন প্রয়োগ করলে গাছ বেশি সবুজ হয় এবং চকচক করে। ছোট চারা রোপন করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে বেশি জলে ডুবে না যায়। বেশি জল দিলে চারা ডুবে যেতে পারে। প্রতি গুছিতে ৬-৮টা চারা রোপন করলে ভালো হয়।
একটা বিষয মনে রাখতে হবে যে আমন ধান সার প্রয়োগ করলে খুব ভালো সাড়া দেয়। জৈবসার মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দেওয়া দরকার। তাছাড়া মাটি পরীক্ষা করে রাসায়নিক সার দিতে হবে। প্রাথমিক চাপান, ইংরেজিতে যাকে বলে টপ ড্রেসিং। মাটিতে কোন সারের কতটা ঘাটতি আছে, মৃত্তিকা পরীক্ষা করে সেই অনুপাতে সার দিতে হবে। মোটামুটিভাবে প্রাথমিক চাপান কতটা দিতে হবে তা এবার বলি। এই তিনরকম উৎপাদনশীল ধানে একটা হারে সার প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়।
অধিক ফলনশীল ধান:
নাইেট্রাজেন-২৫ কেজি, হেক্টর প্রতি
ফসকেট-২৫ কেজি, হেক্টর প্রতি
পটাস- ২৫ কেজি, হেক্টর প্রতি
এই সার তিনটি এই অনুপাতে রোপনের ১০-১৫ দিন পরে প্রয়োগ করতে হবে।
ধানের যখন শীষ উঠবে তার সপ্তাহখানেক আগে শুধু নাইেট্রাজেন সার দিলে ভালো ফলন হয়। এ সময় নাইেট্রাজেন প্রয়োগ করলে শীষ বড় হয় এবং শীষের শাখা-প্রশাখা এবং দানার সংখ্যা বেশি হয়। নাইেট্রাজেন কী হিসেবে প্রয়োগ ক রতে হবে? সাধারণ ইউরিয়া অথবা অ্যামোনিয়াম সালফেট যে কোনও একটি প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণ ইউরিয়াই আজকাল বেশি জনপ্রিয়।
ধানের পাশকাঠি ছাড়ার সময় মাটির সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টা ইউরিয়া অথবা নিম সোলের আবরণযুক্ত ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ফসফেট ঘটিত সার: ধানগাছের বৃদ্ধি, শিকড়ের কার্যকারিতা এবং পুষ্ট দানার জন্য ফসফেট সার খুবই উপকারী। ফসফেট ঘটিত সার হিসেবে সুপার ফসফেট খুবই কার্যকারী। ফলনের শেষ দিকে ফসফেট প্রয়োগ করা ভালো।
পটাশ: পশ্চিমবাংলায় পটাশ সাধারণত জমিতেই থাকে। তবে অধিক ফলনশীল ধানের অল্প মিউরেট অব পটাশ প্রয়োগ করলে ভালো হয়।
সময়: আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। এই সময়টায় ধান রোপন করা সব থেকে ভালো। খেয়াল রাখবেন, ধানের চারা দুই ইঞ্চির বেশি রোপন করলে পাশকাঠির সংখ্যা কমে যায়।
জল: ধানচাষে জলের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি। বৃষ্টি কম হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে কারণ ফুল আসার সময় এবং দানা গঠনের সময় উপযুক্ত জল থাকা উচিত। আগাছা তৈরি হলে, সেগুলো কয়েকদিন পরে পরে নিড়ান দিয়ে তুলে দিতে হবে।
ফসল কাটা: ঠিক সময় ফসল কাটা অত্যন্ত জরুরী। শীষ বের হওযার ৩০-৩৫ দিন পরে ফসল কাটা উচিত।
ফলন: অধিক ফলনশীল ধান হেক্টর প্রতি ৩০-৩৫ কুইন্টাল ধান পাওয়া যায়।
ধানের রোগ: ধানের বিভিন্ন রকম রোগ হতে পারে। ব্যাকটেরিয়ালজাত, ভাইরাস এবং ছত্রাক এই তিন ধরনের রোগ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। সেজন্য সব থেকে ভালো বীজের তলায় অ্যারিটিনা-৬, এক লিটার জলে ২ কেজি বীজ মিশিয়ে অঙ্কুর বের করা উচিত আর বয়স্ক চারায় বাইথেন-এম-৪০ ৩ লিটার জলে মিশিয়ে ধান ক্ষেতে স্প্রে করুন। ২-৩ বার এরকম স্প্রে করলে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন। তাছাড়া শ্যামা পোকা, মাদুড়া পোকা, সান্ধী পোকা, বাদামী শোষক পোকা এসব-এর আক্রমন থেকে ধান গাছকে রক্ষা করতে অ্যান্ডাসালফেন বা ডিমেক্রন-১০০ মাঝে-মধ্যে স্প্রে করুন।