
অরিজিৎ মৈত্র: সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর ট্রিলজি’ নিয়ে আজ পর্যন্ত সম্ভবত কয়েক লক্ষ বার আলোচনা হয়েছে কিন্তু সমালোচকেরা ছবিগুলির সংগীত পরিচালক পণ্ডিত রবিশঙ্করের অবদান নিয়ে নীরব। আজও ছবিগুলি দেখতে দেখতে মনে হয় এমন আবহসংগীত না হলে কি ছবিগুলির আবেদন মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পৌঁছত? রবিশঙ্করের জীবনাবসানের পরেও তাঁর নিজের দেশ অদ্ভুত ভাবে উদাসীন ছিল। মানুষটি সম্পর্কে একটি ধারণা যে ভদ্রলোক একটু আধটু সেতার বাজাতেন, বেশিরভাগ সময়টাই বিদেশে কাটিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছেন, জর্জ হ্যারিসন ও বিটলসদের প্রভাবিত করেছিলেন, গুটিকয়েক হিপি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন আর শাস্ত্রীয়সংগীতের ব্যাকরণকে একেবারে যমালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত জীবনচর্চা অনেক বেশি করা হয়েছে তাঁর বাজনার চেয়ে। সেতারের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর একাধিক জীবনসঙ্গীনির বিষয়টা। অবশ্য শীতকালে শহরে যখন মার্গসংগীতের আসর বসেছে তখন স্ট্যাটাস মেন্টেন করতে সেই সব আসরের প্রবেশপত্র সংগ্রহ করার জন্য এক অদ্ভূত আগ্রহ দেখা গেছে হূজুগে জনতার মধ্যে। সেই সব মানুষেরা তখন বুক ফুলিয়ে বলে বেড়িয়েছেন রবিশঙ্করের বাজনা শুনলাম। আবার একই সঙ্গে কিছু মানুষ বিজ্ঞের মত মন্তব্য করেছেন, গতকালের অনুষ্ঠানে রবিশঙ্কর শুনলাম, সবটাই ফিউসান। শাস্ত্রীয়সংগীতের কৌলিন্য ধ্বংস করে দিয়েছেন ভদ্রলোক।

মাইহার ঘরানার এই প্রণম্য শিল্পী গত কয়েক দশক ধরে দেশে-বিদেশের সংগীতরসিকদের মুগ্ধ করে এসেছেন। শুধু সেতার বাজিয়েই থেমে থাকেননি, সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য সব রাগ, যার মধ্যে রয়েছে ‘পরমেশ্বরী’, ‘তিলকশ্যাম’, ‘রাগেশ্বরী’ ইত্যাদি। ‘পথের পাঁচালী’-র চিত্রনাট্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ রাগাশ্রিত সংগীত না থাকলে ছবিটার আবেদন মানুষের মনে আদৌ রোখাপাত করত কিনা সন্দেহ আছে। অপুর ট্রিলজি ছাড়াও সত্যজিতের ‘পরশপাথর’-এর সংগীত পরিচালনাও করেছিলেন। এগুলো ছাড়াও রবিশঙ্করের সংগীত পরিচালিত ছবির তালিকা বেশ লম্বা। তপন সিংহর ‘কালামাটি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, পূর্নেন্দু পত্রীর ‘স্বপ নিয়ে’। ‘নাগিনীকন্যার কাহিনি’, ‘স্বয়ম্বরা’। হিন্দী ছবির তালিকায় রয়েছে ‘নীচানগর’, ‘অনুরাধা’, ‘মীরা’, ‘গান্ধি’। ‘অঙ্গার’ নাটকের সংগীতপরিচালনাও করেছিলেন পণ্ডিতজি। মাদক সেবনের বিরুদ্ধ প্রচারের জন্য তৈরি করেছিলেন ‘নৃত্যনাট্য ‘ঘনশ্যাম’।

১৯৮৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান গেমস’-এর জন্য থিম সং রচনার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপরে। ‘স্বাগতম শুভ স্বাগতম, আনন্দ মঙ্গল মঙ্গলম’– আজও সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে বাজানো হয়ে থাকে। তাঁর লেখা ‘রাগা’ শীর্ষক ইংরেজি বইতে তিনি নিজের সংগীত এবং ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অকপট। ভারতের রাগসংগীত এবং মার্গসংগীতের কিংবদন্তী শিল্পীদের বিষয়ে নিজের মতামত ও ধ্যান-ধারণা পরিস্কার করে দিয়েছেন। বাংলায় তাঁর বই ‘রাগ-অনুরাগ’ পড়লে তাঁর শিল্পীসত্ত্বা এবং জীবনের নানা ওঠা-পড়া সম্পর্কে জানতে পারা যায়। অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও কিন্তু বাবা আলাউদ্দিন এবং মা মদিনা বেগমের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো ছিল। যাতায়াত ছিল মাইহারের মদিনা ভবনে। মেয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরেও তাঁদের প্রিয় রবু পর হয়ে যাননি।
সংগীত পরিচালনায় তাঁর একটা বিশেষত্ব ছিল। লোকসংগীতের আদলে সুরারোপ করতেন। ছোঁয়া থাকত রাগ ‘মিশ্রমন্ড’ এবং ‘ধুন’- এর। তাঁর বাদনের প্রধান অস্ত্র ছিল মিষ্টত্ব। বিশেষ করে রাগ ‘রাসিয়া’, ‘ভীমপলশ্রী’, ‘দেশ’, ‘সিন্ধি ভৈরবি’, ‘আলিয়া বিলাওল’ – শুনলেই বোঝা যায়। অনুষ্ঠানে কোনওদিনও দীর্ঘ আলাপ বাজাননি। প্রতিটি অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের পালস বুঝে রাগ পরিবেশন করতেন কিন্তু অনুষ্ঠানের মাঝখানে হাততালি দেওয়া পছন্দ করতেন না। আক্ষেপ করে বলতেন বিদেশের মত এখানকার শ্রোতারা কেন যে বাজানো শেষ হলে ওবেশন দেয় না বুঝতে পারিনা। বাজানোর মাঝে হাততালি পড়লে শিল্পীর মনোসংযোগ নষ্ট হয়ে যায়।

শৈশবের শিক্ষা শুরু হয়েছিল মাইহারে। দাদা উদয়শঙ্করের ব্যালে ট্রুপ ছেড়ে মাইহারের রুক্ষ মাটিতে চলে যান বাবা আলাউদ্দিন খানের কড়া অনুশাসনে। ভাই আলি আকবরের সঙ্গে শুরু হয় যন্ত্রশিক্ষা। সেই শিক্ষা রক্তে মিশে যায়। সেই শিক্ষাই পরবর্তীকালে তাঁর পরিবেশনে প্রতিফলিত হয়। মনটা যখন বিক্ষিপ্ত থাকে, তখন লুপ্তপ্রায় ক্যাসেটে বাবা আলাউদ্দিন খান সৃষ্ট রাগ ‘আশা ভৈরব’ শুনলে হারিয়ে যাওয়া শান্তি ফিরে আসে। আশির দশকে দক্ষিণ কলকাতার এক পার্কে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সের শেষ অধিবেশনে পণ্ডিতজি বাজিয়েছিলেন। ভোর রাতের সেই সুরেলা আসরে কিছু মানুষ যখন নিজেদের আসন থেকে উঠে ঘোরা-ফেরা করছেন তখন পণ্ডিতজি তাঁর সুরেলা় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘যাঁরা যাবেন তাঁরা এই বেলা গেলে ভালো হয়, আর যাঁরা থাকবেন, তাঁদের জন্য আমি বাজাবো রাগ ‘আশা ভৈরব’। এই রাগ আমার তৈরি নয়, বাবার সৃষ্টি। বড় মিষ্টি মন কেমন করা এই রাগ।

সারা জীবন রাগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, ইম্প্রোভাইজ করেছেন কিন্তু রাগ-রাগিনীর ব্যকরণকে অক্ষুণ্ণ রেখে। কীর্তন, লোকসংগীত, সব কিছু ধরা পড়েছে তাঁর সৃষ্টিতে। গুলজার পরিচালিত ‘মীরা’ ছবিতে রাজস্থানী ফোক এবং পূরবী রাগের এক অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায়। ছবির শেষ দৃশ্যে ব্যাবহৃত ‘প্রেম দিওযানি’ গানে পূরবীর মূর্চ্ছনায মন উদাস হযে যায়। তাও নানা সময় রব উঠেছে রবিশঙ্কর যা করেছেন, সবটাই ভুল। এমন অভিযোগের কথা তিনি নিজেই অনেক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। কাশির বেনীমাধবের ধ্বজা থেকে ইফেল টাওয়ার, এক দীর্ঘ সাংগীতিক যাত্রায় তিনি ক্লান্ত হননি। নিজের উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে ভারতীয় মার্গসংগীতের এক নতুন রূপকে প্রকাশ করেছিলেন শ্রোতাদের কাছে। সেখানেই বোধহয় বিতর্ক। কিন্তু আজকের শিল্পীরা যখন নিজের গাল বা কলসি বাজিয়ে ফিউশন তৈরি করে, তখন তো বোদ্ধাদের ধন্য ধন্য করতে শুনি। তাহলে কি যুগ পাল্টেছে না মানুষের পছন্দ? জানিনা। তবে ভারতের মার্গসংগীতের অন্যতম প্রাণপুরুষ পণ্ডিত রবিশঙ্কর রাগসংগীতে যে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন, এ কথা বলাই বাহুল্য। বলা যায় তাঁর জন্যই বিদেশী সংগীতরসিকেরা ভারতীয় রাগসংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ভারতীয় মার্গসংগীতের রাষ্ট্রদূত পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণদিবসে তাঁর সংগীত সম্পর্কে আলোচনা করেই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন করা হল। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন গ্লোবাল অ্যাম্বাসাডার অফ ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিক।