উল্টোন স্মৃতির পাতায় প্রণব…..

তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে স্টেটসম্যান
অগ্নিমিত্রা পাল: দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ প্রণব মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এক বর্ণময় রাজনৈতিক যুগের অবসান হল। ভারতীয় রাজনীতি এবং সংসদীয় রীতির মধ্যে প্রণবদা কংগ্রেস দলের বহুল পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব ও ‘মুস্কিল আসান’অর্থাৎ ‘ট্রাবল শুটার’নামে পরিচিত ছিলেন। প্রণববাবু শুধুমাত্র একজন রাজনীতিক এবং কংগ্রেস নেতাই ছিলেন না, উনি ছিলেন একজন প্রকৃত অর্থে স্টেটসম্যান। স্বাধীনতার পর থেকে যে সকল রাজনীতিবিদ পশ্চিমবঙ্গ থেকে সর্বভারতীয় স্তরে জনপ্রিয় হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রণবদা ছিলেন অন্যতম।
কেন্দ্রীয় সরকারের অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, যার মধ্যে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, অর্থ ইত্যাদি ছিল। ছিলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানও। উনি ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ অর্থমন্ত্রী যা একটা বিশেষ মর্যাদা বহন করে। ওঁর এই হঠাৎ চলে যাওযায় আমরা শোকাহত। সেই স্থান পূর্ণ হওয়া খুব কঠিন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
তাঁর সাহিত্য প্রীতিতে আমি বিমুগ্ধ
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: প্রণববাবু একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক এবং ভারতের প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতিও বটে। বেশ কিছু কাল ধরেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সময় করে নিয়ে বহু রকমের বই পড়তেন। এক সময় অধ্যাপনাও করেছেন। নিখীল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের কয়েকটা সভায় ওঁর সঙ্গে আমার একাধিকবার দেখা হয়েছে। মনে পড়ে সেই সময় সাহিত্য নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তখন একটা জিনিস লক্ষ করতাম যে বই পড়া বা সাহিত্য সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে এমন সব বইয়ের রেফারেন্স উনি দিতেন যে আমি ভীষণই অবাক হয়ে যেতাম। নানা বিষয়ের বই পড়তেন। কী করে যে এত সময় পেতেন জানিনা। নিখীল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে যে সব ভাষণ তিনি দিতেন সেখানেও প্রণববাবুর সাহিত্য বিষয়ক মনোজ্ঞ বক্তব্য আমাকে বারে বারে মুগ্ধ করেছে।
প্রণববাবু যখন রাষ্ট্রপতি হলেন, সেই সময় একবার তাঁর একজন আপ্ত-সহায়কের মাধ্যমে আমাকে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে কয়েকদিন থাকতে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি ওঁনার সেই অনুরোধ রাখতে পারিনি। তার একটা কারণ হল ওই ধরনের হাই-প্রোফাইল জাযগায় যাওয়া বা গিয়ে থাকাটা আমি কিছুটা এড়িয়ে চলতে চাই। তাছাড়া অনেকেই জানেন যে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেশের প্রথম নাগরিকের কাছাকাছি থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রোটকল মেনে চলতে হয়, তাই প্রণববাবুর সেই প্রস্তাবে আমি সম্মত হইনি। কিন্তু ওঁর সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আমাকে খুশি করেছে। ওঁর প্রতি আমার ভীষণই শ্রদ্ধা রয়েছে। আমার সেই ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা আগামী দিনেও থাকবে।
বন্ধুর হাত থেকে পদ্মশ্রী নেওয়া
পূর্ণচন্দ্র দাস বাউল: আমরা দুজনেই বীরভূমের বাসিন্দা। পরোটা গ্রামের পাশের গ্রামেই আমার বাড়ি ছিল। প্রণববাবু বয়সে আমার থেকে দু বছরের ছোট। আমাদের দু’জনেরই বাড়ি কাছাকাছি থাকাতে একই স্কুলে পড়তাম| স্কুলের নাম ছিল ‘কীর্ণাহার হাই স্কুল’। কখনও ও স্কুলে তাড়াতাড়ি পৌঁছত আবার কখনও আমি স্কুলে তাড়াতাড়ি পৌঁছতাম। টিফিনের সময় এক সঙ্গে খেলাধুলোও করতাম। ও অনেক দূর থেকে হেঁটে স্কুলে আসত। বর্ষাকালে জল ভেঙে এবং প্রচুর কাদা পেরিযেও ওকে আসতে দেখেছি। ডাক নাম ছিল ‘পল্টু’। প্রণববাবুর বাবা কামাদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় ওঁকে খুব ভালোবাসতেন। সত্যি কথা বলতে কী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের সঙ্গে আমাদের একটা পারিবারিক যোগাযোগ ছিল। ওঁর বাবার সঙ্গে আমার বাবা নবনীদাস বাউলের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল| যাতায়াত তো ছিলই।
প্রতি বছর দুটো পরিবার একসঙ্গে অজয়ের পারে জয়দেব মেলাতে যেতাম। প্রণববাবু সেখানে একবার কী দুবার গিয়েছিলেন। খুব বেশি আসত না কারণ ও নিজের পড়াশোনা নিয়ে ভীষণই ব্যস্ত থাকত। ও খুবই নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে চলত। পরে যখন রাজনীতিতে যোগ দিল, তখন তো আরও ব্যস্ত হয়ে গেল। আমরাও এক সময় কলকাতায় চলে আসি। এখানে এসেও সেই যোগাযোগটা বিছিন্ন হয়ে যায়নি। সব সময় দেখা সাক্ষাৎ না হলেও যোগাযোগের সূত্রটা রয়ে গিয়েছিল। আমার ছেলেরা দিল্লিতে গেলে ওঁর বাড়িতেই উঠত। আমিও কোনও অনুষ্ঠান করতে গেলে বেশিরভাগ সময়ই দিল্লিতে ওঁর কাছেই থাকতাম। কয়েক বছর আগে যখন আমাকে ‘পদ্মশ্রী’ দেওয়া হল, তখন রাষ্ট্রপতিভবনে আমার ছোটবেলার বন্ধু প্রণবের হাত থেকেই সেই পুরস্কার নেওয়াটা আমার কাছে একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে।
ব্যস্ততার মাঝেও তিনি দেখা করতেন
তরুণ মজুমদার: যখন অসুস্থ ছিলেন তখন টিভির পর্দায় চোখ রাখতাম ওঁর খবর নিতে। কখনও শুনতাম অবস্থার অবনতি ঘটছে আবার কখনও শুনতাম চিকিৎসায় তিনি সাড়া দিচ্ছেন। দ্বিতীয়টা শুনলে মনে একটা নিশ্চিন্ত ভাব দেখা দিত। প্রণববাবু আর ওঁর সহধর্মিনী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল। যখনই কোনও কাজে দিল্লিতে যেতাম জানি না কী করে ওঁরা জানতে পারতেন, যে হোটেলে উঠতাম, সেখানে ফোন করে নিজেরাই গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন অবাক হয়ে ভাবতাম আমার মত একজন নগণ্য ব্যক্তি কখন দিল্লিতে আসছেন সেই খবর তাঁরা পেতেন।
প্রণববাবু তখন দেশের অর্থমন্ত্রী, চূড়ান্তভাবে ব্যস্ত। ওঁনার বাড়িতে গিয়ে দেখতাম বাইরে গাড়ির প্রকাণ্ড লাইন। অনেক মানুষ আসতেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
শুভ্রা দেবী আমার যাওয়ার সংবাদ দিলে, তখনই এসে দেখা করে যেতেন। সামান্য কিছু কথার পরে বলতেন, ‘কিছু মনে করবেন না, অনেকের সঙ্গে দেখা করতে হবে, তাই আমাকে একটু যেতে হচ্ছে।’ ভীষণ সুন্দর ব্যবহার। প্রণববাবু এবং শুভ্রাদেবী দু’জনেই আমার ছবি দেখতেন এবং পছন্দ করতেন। বলেওছিলেন সেই কথা। তাঁর ভদ্র ও মার্জিত ব্যবহারের কথা আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে। মনে থাকবে সেই সব সুন্দর দিনের সুন্দর সব স্মৃতি।
শুধু রাষ্ট্রনেতা নন, সংস্কৃতিবান
শর্মিলা ঠাকুর: সবাই জানেন যে প্রণব মুখোপাধ্যায় একজন বর্ষীয়ান এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিবিদ। পাশাপাশি তিনি একজন প্রবীণ সাংসদও বটে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে ওঁনার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। রাজনীতিক হয়েও ওঁনার অনেক বিষয়েই আগ্রহ ছিল। তার মধ্যে ছিল শিল্পকলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। উনি যখন আমাদের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, সেই সময় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল প্রণববাবুর হাত থেকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান নেওয়ার। শুধু তাই নয় অসমের সর্বোচ্চ সম্মানও আমি ওঁর হাত থেকেই নিই।
ওঁনার সঙ্গে আমার অনেকদিন ধরেই খুব ভালো সম্পর্ক। আমার সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে তখনই উনি টাইগার সম্পর্কে ওঁর ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন। আমি যখন ফিল্ম সেনসার বোর্ডের চেযারপার্সন ছিলাম সেই সময় ‘রং দে বাসন্তী’ছবিতে এয়ারফোর্স সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। উনি তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ওঁকে আমরা ছবিটা দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও উনি পুরো ছবিটা দেখে খুশি হয়েছিলেন এবং দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিলেন ছবিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভূমিকা দেখানোর বিষয়ে ওঁনার কোনও আপত্তি নেই।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে উনি একাধিকবার রাইসিনা হিলস-এ আমাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মনে আছে, একবার ওঁনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার কারণে আমাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ করেন। সেখানে ওঁনার স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আলাপ হয়। রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রেক্ষাগৃহে যখনই কোনও ছবি প্রদর্শিত হয়েছে, তখনই উনি আমাকে ছবির কলাকুশলীদের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, ওঁর জ্ঞান এবং আথিতেয়তা প্রতি রয়েছে আমার গভীর শ্রদ্ধা।
ওঁর একটা ছবি এঁকেছিলাম
যোগেন চৌধুরী: উনি যখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়। দিল্লিতে যখনই ওঁর বাড়িতে গেছি, তখনই ভালো মত আড্ডা হত। দারুণ গল্প করতে পারতেন। প্রতিক্ষণের প্রিয়ব্রতবাবুও অনেক সময় সেই আড্ডায় যোগ দিতেন। প্রণববাবুর সঙ্গে ওঁর অনেকদিনের পরিচিতি। প্রণববাবুকে প্রথম দেখি দিল্লিতে প্রাক্তন মন্ত্রী এবং যাদবপুরের অধ্যাপক ড. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। তখন উনি যাকে বলে একদম ইয়ং ম্যান। এরপর রাজনীতিবিদ সুখেন্দুশেখর রায় যখন ওঁনাকে নিয়ে বই করেছিলেন, তাতে আমি প্রণববাবু সম্পর্কে লিখেছিলাম। এক সময় শিল্প সম্পর্কিত একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। অনেক চিত্রশিল্পীই সেখানে যুক্ত ছিলেন। সেই সংস্থার উন্নতি, প্রচার ও প্রসারের জন্য প্রণববাবু মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়াকে বলে আমাদের জন্য ৫ কোটি টাকার এক বিশাল অনুদানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই টাকা পেয়ে আমরা অনেক কাজও করি।
উনি দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে শিল্পী, সাহিত্যিক এবং সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য রাষ্ট্রপতিভবনে থাকার জন্য ব্যবস্থা করেন। চিত্রকর হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে আমি সেখানে গিয়ে প্রায় একমাস ছিলাম। ওই সময় ওঁর একটা ছবিও আমি এঁকেছিলাম। সেই ছবিটা এখনও ওঁনার কন্যা শর্মিষ্ঠার বাড়িতে রয়েছে। ওঁর খুব পছন্দ হয়েছিল ছবিটা। সেই কারণে আমি ওই ছবিটা রাষ্ট্রপতিভবনে না দিয়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্যেই ডোনেট করেছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে সত্যম রায়চৌধুরীর টেকনো ইন্ডিয়ার অনুষ্ঠানে প্রণববাবুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। ওঁনার কলকাতার বাড়িতে আমার যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেটা একটা আপশোষ রয়ে গেল।