সিটিজেন মুখার্জি চিরঘুমের দেশে, রইল তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে আকীর্ণ পথ

অরিজিৎ মৈত্র: রাঢ়বঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের মিরিটি গ্রাম। এই গ্রামের শিক্ষক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী কামাদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের পুত্রের রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। শুধুমাত্র কংগ্রেস পরিবারের সদস্য আর ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বাসভাজন ও আনুগত্যই যে তাঁকে বারংবার কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ এমনকী দেশের সর্বোচ্চ আসন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে, ভাবলে ভুল হবে।
ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম বিচক্ষণ, প্রবীণ এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বলা হত ‘চাণক্য’। কী কী কারণে এমন বিশেষণ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রতি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা বোঝার মত রাজনৈতিক জ্ঞান বা বিশ্লেষণ আমার কোনওদিনই ছিল না এবং আজও নেই। তবে নিজের ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণে বলতে বাধা নেই যে জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সমকালীন রাজনীতির বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সব সময় সহমত না হলেও মানিয়ে নিয়েছেন। সরকারে যেন নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন, তেমনই বিরোধী আসনে বসে তৎকালীন সরকারের ইতিবাচক বিরোধিতাও করেছেন। ফুটবল টিম বদলের মত ঘন ঘন রাজনৈতিক শিবির বদল করেননি। একবারই ১৯৮৪-৮৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে ডা. শিশির বসু সহ কয়েকজন কংগ্রেস নেতাকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’। কিন্তু চিরকালীন কংগ্রেসম্যান প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুরনোও দলের সেই বিচ্ছেদ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। পুরনো দলে আবার ফিরে আসেন ১৯৮৮ সালে।
তাঁকে বলা হত ‘দ্য ম্যান অব অল সিজেনস’। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত ছিলেন কংগ্রেসের ক্রাইসিস ম্যানেজার। সংবিধানের নিয়ম অনুসারে দলের সঙ্গে দীর্ঘ ৪০ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেশের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। দেশের সুপ্রিম কম্যান্ডার সর্বোচ্চ আসনে থাকাকালীন কখনওই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ইয়েসম্যান ছিলেন না। আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁকে কোয়ালিশান বা জোট সরকারের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। পাঁচ বছর রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তাঁর দৃঢ়চেতা চরিত্র কোনওদিনই তাঁর কাছে আসা প্রতিটি প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ করেছিল। রাইসিনা হিলের প্রাসাদে থাকার সময়ে সুযোগ হত বই পড়ার। অনেকেই জানেন তিনি সাহিত্যপ্রেমী। যখনই সময় পেয়েছেন, তখনই বই হাতে তুলে নিয়েছেন। প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, সুনীল, শীর্ষেন্দু। নিজেও কলম ধরেছেন। লিখেছেন একাধিক গ্রন্থ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড-দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’, ‘দ্য টারবুলেন্ট ইয়ার্স, ‘কোয়ালিশান ইয়ার্স’ ইত্যাদি।
পরিচয়ের সুযোগে তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি সাহিত্যপ্রীতির কথা। যখন পরিচয় হল, তখন তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি। এর আগে প্রণববাবুর ছবি দেখেছিলাম ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে। প্রথম আলাপের জন্য সাক্ষাৎ তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক হিসেবে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যখন কলকাতা রাজভবনে যাই প্রণববাবুকে আমন্ত্রণ জানাতে, সেই সময়।সঙ্গে ছিলেন প্রণববাবুর দীর্ঘদিনের পরিচিত শ্রেনিক শেঠ।
এরপর থেকে যখনই কলকাতায় এসেছেন, প্রায় প্রতিবারই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে কোনও না কোনও কারণে। বন্ধু ও সহকর্মী মনীষা এবং আমি যুগশঙ্খের প্রয়োজনে বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী গিরিজা দেবীর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার রেকর্ড করি এবং শিল্পীর জীবনাবসানের পরে সেটি অডিও সিডি আকারে প্রকাশিত হয়। সেই বিশেষ সিডিটি দিতে ওঁর সঙ্গে দেখা করি। মনে আছে সেই দিন প্রণববাবুর পূর্ব পরিচিত এবং আমার মায়ের পিসি আকাশবাণীর জনপ্রিয় সংবাদ পাঠিকা নীলিমা সান্যালের বিষয় সামান্য কিছু কথা হয়। এর পরের বছর প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য আর আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি কলকাতায় প্রণববাবুর বাড়িতে। উদ্দেশ্য বইয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথা জানার। অনেক কথার মধ্যে সেদিন বলেছিলেন তাঁর ডায়রি লেখার অভ্যাস নিয়ে। গ্র্যাজুয়েশন করার পর থেকেই ডায়রি লেখার অভ্যাস। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিত লিখতেন। কিন্তু একই বছরে দিল্লিতে জুন মাসে কয়েকদিন অস্বাভাবিক বৃষ্টিতে জল জমে যায়। ডায়রিগুলো ছিল তাঁর বাড়ির বেসমেন্টে। সবগুলোই নষ্ট হয়ে যায়। এরপর হতাশা থেকেই পরের ৩ বছর আর লেখেননি। তারপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিমা রাওয়ের কথায় আবার লিখতে শুরু করেন। সেদিন কথায় কথায় বুঝতে পেরেছিলাম তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাওয়ের একজন গুণগ্রাহী ছিলেন।
পুরনোও স্মৃতিকে রিফ্লেক্ট করতে করতে ১২ বছরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দলিল লিখে ফেলেন। বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্রন্থাগারের কথা আর সঙ্গে পূর্বতন রাষ্ট্রপতিদের বিষয়ভিত্তিক বইয়ের প্রতি আগ্রহের কথা। ওঁর কাছে শুনেছিলাম শ্রীমতি গান্ধীর আগ্রহ ছিল সোশ্যাল কাস্টামস, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের প্রতি। এছাড়াও ইংরেজি সাহিত্যের বইও খুব পড়তেন। যখন বিদেশ গিয়েছেন, তখন বিভিন্ন বিষয়ের বই এনে দিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধীকে। জেনেছিলাম যে একজন রাষ্ট্রপতির কার্যকাল শেষ হলে, সেই সময়ের নথি বা দলিল চলে যায় রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্রন্থাগারে। ওঁর ‘ভারতরত্ন’ পাওয়া উপলক্ষ্যে সেই সাক্ষাৎ যুগশঙ্খে প্রকাশিতও হয়েছিল।
যুগশঙ্খের শারদীয়া সংখ্যাটিও ওঁর হাতে তুলে দিয়ে ভালো লেগেছিল কারণ তাঁর সাহিত্যপ্রীতি। অসম্ভব ভালো ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কিত একটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা পড়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন এবং প্রায় ছ’মাস পরে আমায় সেই কথা বলেওছিলেন। প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতি যখন কলকাতার বাড়িতে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে দেখা করতেন, সেই সময়ের মধ্যেও চোখে পড়েছিল তারাশঙ্করের বইয়ের পাতায় চোখ রাখছেন। তাঁর আর্থিক সহায়তায় কয়েক বছর আগে বীরভূমের লাভপুরে গড়ে উঠেছে তারাশঙ্কর প্রদর্শনশালা।
তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা গত বছর অক্টোবরে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আমার সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশ করার অনুরোধ নিয়ে গিয়েছিলাম। সম্মত হয়ে বলেছিলেন, ‘চিঠিটা আমার আপ্ত-সহায়ক চোপড়ার কাছে রেখে যাও, পুজোর সময় যখন আসব, তখন অনুষ্ঠানটা করা যেতে পারে।’ আপশোষ রয়ে গেল সেই অনুষ্ঠান আর করা গেল না। সেই বইটাও তাঁর হাতে আর তুলে দেওয়ার সুযোগ হল না। পূর্ণ বিশ্বাস ছিল গণতন্ত্র এবং ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি। ‘দ্য মেজরিটি হ্যাজ গট দ্য ম্যান্ডেট টু রুল অ্যান্ড দ্য মাইনরিটি হ্যাজ গট দ্য ম্যান্ডেট টু অপজ। বাট নোবডি হ্যাজ গট দ্য ম্যান্ডেট টু অবস্ট্র্যাক্ট’। এই ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি।
ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে ড. মনোমহন সিং মন্ত্রিসভায় প্রণব মুখোপাধ্যায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতর সামলেছেন, যার মধ্যে ছিল ‘জাহাজ’, ‘বাণিজ্য’, ‘স্টিল অ্যান্ড মাইনস’, ‘পররাষ্ট্র’, ‘প্রতিরক্ষা’, ‘অর্থ’ইত্যাদি।
ছিলেন প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। প্রণববাবু তাঁর প্রথম বাজেট পেশ করেন ১৯৮২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। বাজেট সংক্রান্ত সেই ভাষণের সময়সীমা ছিল ১ ঘন্টা ৩৫ মিনিট। প্রণববাবুর শারীরিক দৈর্ঘ্য লক্ষ করে ইন্দিরা গান্ধী কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘দ্য শর্টেস্ট ফিনান্স মিনিস্টার ডেলিভার্ড দ্য লংগেস্ট বাজেট স্পিচ’।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এক বিপদজনক বিতর্ক দানা বেঁধেছিল সেই বাজেট বিতর্কে। বিরোধীপক্ষের এক বর্ষীয়ান সাংসদ রবীন্দ্র বর্মা অভিযোগ করেন যে লোকসভায় পেশের আগেই বাজেট সংক্রান্ত নথি আই.এম.এফ-এর হাতে তুলে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। লোকসভায় উপস্থিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রণব মুখার্জিকে রাজ্যসভার থেকে লোকসভায় ডেকে পাঠান। সভায় ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ অর্থমন্ত্রী রবীন্দ্র বর্মার বক্তব্য শুনে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেন চিন্তা না করতে। আগামীকাল তিনি সভায় এর উত্তর দেবেন। পরের দিন সভায় নির্দিষ্ট সময়ে অর্থমন্ত্রী তাঁর ভাষণে অভিযোগকারীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বাজেট সংক্রান্ত তথ্যের যে অংশ আপনি সভায় পড়ে শুনিয়েছেন, তা সত্য কিন্তু একটা ছোট্ট ভুল আপনি করে ফেলেছেন, সেটা হল ১৯৮১-৮২ সালে পেশ করা বাজেটের অংশবিশেষ এবং সেটা নিয়ে আই. এম. এফ-এর সঙ্গে আলোচনা করাটা স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে।’
এমনই ছিল তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। অযথা অশালীন বাক্য ব্যবহার করে বিরোধী বা সরকারকে আক্রমণ না করে ঠান্ডা মাথায় সংসদের বিতর্কে অংশ নিয়ে উপযুক্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সঙ্গত এবং তা সংসদীয় রীতির পক্ষে বলে তিনি চিরকাল বিশ্বাস করে এসেছেন। সরকার এবং বিরোধীপক্ষের বিবাদের জেরে সংসদ অচল হলে তিনি বিচলিতবোধ করতেন। মনে করতেন গণতন্ত্রের পক্ষে এ অশুভ ইঙ্গিত।
দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ যে নিরপেক্ষতার প্রতীক, তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন বারে বারে। নাগপুরে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সভায় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু আমার নিজের মনে হয যে সেই সভায় গিয়ে তিনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেন। ভাষণে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’-র কিছু অংশও পড়ে শোনান। সেই সভায় তাঁর অংশগ্রহণ নিযে বিতর্কের কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আজও খুঁজে পাইনি, এটা অবশ্যই আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত।
দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরে দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রর মত ব্যবহার করার মানুষ তিনি নন এবং সেটা কাম্যও নয়। ভারতবর্ষের মত বিশাল দেশে মাল্টি পার্টি ডেমোক্রেসির মধ্যে নানা মতামতের প্রকাশ থাকবেই এবং সেটাই একটা গণতান্ত্রিক দেশের সৌন্দর্য, এমনভাবেই ভারতীয় গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর গুণগান করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমায়।
দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালীন ‘হিজ এক্সেলেনসি’ শীর্ষক ইংরেজি শব্দ দুটিকে তিনি বর্জন করেছিলেন। আর সেই পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরে নিজেকে বলতেন ‘সিটিজেন মুখার্জি’। সেই সিটিজেন মুখার্জির দেখানো পথে রাজনীতি করে এবং নির্বাচিত সরকারের কাজে অংশগ্রহণ করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও উজ্জ্বল এবং শক্তিশালী করলে দেশের পক্ষে তা মঙ্গলজনক হবে।