রাষ্ট্রপতির সংসারে

দেবারতি মিত্র: ভোর ছটা বা পাঁচ দশ মিনিট এদিক ওদিক। শীতের কনকনে দিল্লি। স্থান-তালকাটোরা রোড। মাথায় অচেনা এক স্পর্শে ঘুম ভাঙাল। চোখ খুলতেই মিসেস মুখার্জি বললেন, ‘উঠিসনা উঠিসনা, আমি তোর মাথায় একটু জপ করে দিতে বলেছি, বড্ড ভুগছিস তুই।’ কয়েক মুহূর্ত পর মাথা থেকে তাঁর স্পর্শ সরে গেল। ধীরে ধীরে ঠাকুরঘর অভিমুখী হলেন তিনি। আমার ঘুমের ঘোর তো ছুটে গেছে কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর যে আর কাটেই না।
এর কিছুদিন পর ১৩ নম্বরের পিছনের খোলা মাঠে এক ফ্লাক্স চা নিয়ে বসে একরাশ সংবাদপত্র পড়ার ফাঁকে স্ত্রীয়ের থেকে আমার কথা সব জেনেছিলেন তিনি। পরেরদিন থেকে আমাকেও ওঁনাদের সঙ্গে চা খেতে ডাকতেন। অবশ্য তার একটা কারণও ছিল, আমার গলায় রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে ভালোবাসতেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। আমার সুবিস্তৃত চিকিৎসা হয়েছিল তখন ওঁদের পারিবারিক চিকিৎসক ডা. মণ্ডলের তত্ত্বাবধানে। তবে চিকিৎসার নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন। আর দেখতে পেলেই জিজ্ঞাসা করতেন আমি কেমন আছি। শরীরের থেকেও মনের কষ্টে ভুগতাম কিছু ব্যক্তিগত কারণে। শুভ্রা মুখার্জি ও প্রণব মুখার্জির পরম ভালোবাসা আমাকে অনেকটাই সুস্থ করে দিয়েছিল।
২০১২ সাল, দুর্গাপুজো। মিরীটির মুখার্জি বাড়ির দুর্গাপুজোয় এক প্রকার ধরে বেঁধেই নিয়ে গেলেন মিসেস মুখার্জি। নবমীতে বেঙ্গালুরুর আর টি নগরে আমার গানের প্রোগ্রাম। তাও মিরীটির পুজোয় গেলাম জোরাজুরিতে। সপ্তমী সকাল, প্রণববাবুর বড়দিদি অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়ির মাঝখানে একটা বড় উঠোন। চারদিকে কালো পোশাকে দেহরক্ষী। পারিবারিক সেই সভায় পুজোর শাড়ি উপহার দেওয়ার পর্ব প্রায় যখন শেষ, ঠিক তখন খাস পরিচারিকা অনুরাধাদিদির থেকে একটা ফর্দ দেখতে চাইলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী মহাশয়।
আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে সবই প্রত্যক্ষ করছি। উনি আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন ওর জন্য শাড়ি আনোনি? মিসেস মুখার্জি বললেন, সে তো একমাস আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর যুক্তি ছিল অন্য। ওঁনার দেশের বাড়িতে প্রথম গেছি আমি, তাই ওঁনার পক্ষ থেকে আমাকে একটা শাড়ি দেওয়া উচিৎ। এই বলে তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক দায়িত্বপরায়ণ ভাগ্নেবৌ’ কে টাকা দিয়ে বললেন, ‘দেবারতির জন্য একটা তাঁতের শাড়ি কিনিস।’ মুকুলবৌদি আমার জন্য গোলাপি তাঁতের শাড়ি কিনেছিলেন। পরেরদিন ফেরার সময় কীর্ণাহারের দুর্গাপুজোর জন্য তো নিশ্চয়ই তবে তাঁর থেকেও বেশি মন খারাপ হয়েছিল ওঁনার জন্য, গোলাপি তাঁতের শাড়িটাই পরেছিলাম যে ওটা আজও সযত্নে রাখা আছে।
আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে যাঁর সংসার সেই ভারত সংসারের রাষ্ট্রপতি মহাশয়ের কাছে নিজের সংসারটা তো সামান্য। মিসেস মুখার্জি অদ্ভুতভাবে বুঝতেন আমাকে। আমি কোনও কারণে শারীরিক বা মানসিক কষ্ট পেলে উনিও খুবই দুঃখ পেতেন আমার জন্য। জানিনা কোন এক অদৃশ্য কারণে আমি তাঁর অতীব স্নেহের পাত্রী ছিলাম। ওঁনার খুব কাছে থাকার জন্য অনেকেই আমাকে ওঁনার কন্যা ভেবে ভুল করতেন। আর এই গভীর আন্তরিক সম্পর্কটিকে নিয়ে প্রচুর ঝড় ঝাপটা থাকা স্বত্বেও আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মহাশয় সবার অলক্ষ্যে স্ত্রীকে সমর্থন করতেন। আমার চোখের অপারেশন নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে তখন বহুবিধচর্চা, সে সময় কারুর কোনও কথা না শুনে স্ত্রী’র ভালোবাসা স্নেহকেই লালন করেছেন তিনি। খুব যত্ন ও সম্মানে আমার অপারেশন করিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনেই আমাকে থাকতে বলেছিলেন। ভবনে থাকাকালীনও আমি দেখেছি ওঁনার সেই সাধারণ জীবনযাত্রা। উনি সেই কাকভোরে উঠে স্ত্রীয়ের মাথায় জপ করে পুজো করতে যেতেন। তাঁর খাস পরিচারক পদমদাকে জোরে জোরে ডাকতেন পদম পদম বই পড়ার পর রাত দুটো তিনটের সময়।
নানা মানুষের খুঁটিনাটি তথ্যও দারুণ মনে রাখতেন প্রণব মুখার্জি। ২০১৩,মার্চ মাসে রাষ্ট্রপতি সফরে ডেলিগেটস হিসাবে অধীর চৌধুরী, মুকুল রায়, চন্দন মিত্র ও সীতারাম ইয়েচুরি, চিফ প্রোটোকল অফিসার রুচিরা কম্বোজ, বর্তমান অ্যাম্বাসাডার (ইউ কে) গায়ত্রী ইশার কুমার প্রমুখের সঙ্গে বিমানের একটি বিশেষ বিভাগে আমিও ছিলাম। একটু আধটু যখন আমরা গল্পরত তখন মহামহিম এসে প্রত্যেকের সঙ্গে গল্প করছিলেন বেশ, সবার মুখে তখন একটাই রা, প্রণবদা আর প্রণবদা। আমি শুধু চুপ। হঠাৎ আমার দিকে তাকালেন, বললেন, ‘ভেতরে যাও, মা একা আছে।’ আমি বাধ্য মেয়ের মত বললাম যাচ্ছি বাবা। স্বাভাবিক, রাষ্ট্রের যিনি পিতা, তিনি তো আমারও পিতা। লকডাউনের আগে আমাদের শেষ দেখা। শুভ্রা মুখার্জি সম্পর্কিত আমার লেখা ‘গীতা এক জীবনগীতি’-র পাণ্ডুলিপিটা দেখতে চাইলেন। বললেন, বইটা ওঁকে দেখিয়ে তাড়াতাড়ি প্রকাশ করতে। তখন বুঝিনি বড়ই তাড়া ছিল যাবার। দ্বিতীয়বার পিতৃহারা হলাম।