৪৬ এ হিন্দু নরমেধ যজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী জ্যোতি বসু ও বর্তমান কমরেড সমাজ
ঋদ্ধিমান রায়: ‘১৯৪৬ সালের কলকাতা হত্যাকাণ্ড’ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত পড়াশোনা করতে গিয়ে ‘ছাই চাপা আগুন’ এর মত মজাদার একটি তথ্য পাওয়া গেল! উক্ত হিন্দু নিধন কাণ্ডের কোনো স্মৃতিই বস্তুত মজাদার নয়, তবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্য তা অদ্ভুত ভাবে অদ্ভুত! কারণ, যে কমিউনিস্ট পার্টি মুসলিম লীগকে তোষণ করে পাকিস্তানের জন্ম দিতে সাহায্য করে, সেই পার্টির তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা জ্যোতি বসুর জবানবন্দীতেও উঠে এসেছে কলকাতা হত্যাকাণ্ডের নারকীয় বর্ণনার খন্ডচিত্র! সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার! একটু গোড়া থেকেই শুরু করা যাক।
১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট জিন্নার ডাকা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস বা Direct action day কে সফল করার উদ্দেশ্যে এক পক্ষকাল পূর্ব থেকেই জোরদার প্রচার শুরু হয় কলকাতায়। কলকাতা সেই সময় লীগের প্রধান শক্তি। পাকিস্তান গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে প্রথমে কলকাতা ও এরপর হাওড়াকে হিন্দুশূন্য করার ভয়াবহ ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হয় নিপুণ ভাবে। বিভিন্ন মহল্লা, মসজিদ, মাদ্রাসাগুলিতে মজুত করা হতে থাকে লোহার রড, কাটারি, দা, সড়কি, বন্দুক ইত্যাদি। মুসলিম ঘরবাড়িতে গিয়ে বিলি করা হয় একশন প্ল্যানের লিফলেট। প্রকাশ্যে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, সময়টা পবিত্র রমজান মাস। এই রমজান মাসেই জিহাদ করে মক্কা জয় করা হয়েছিল। তাই এই সুবর্ণ সময়েই মুসলিম লীগের নেতৃত্বে কাফের হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজকে জিহাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
নিরীহ হিন্দুরা তখনো পর্যন্ত জিহাদের স্বরূপ সম্পর্কে অবগত নয়! তারা এই প্রত্যক্ষ সংগ্রামকে গান্ধী পরিচালিত ঢাল-তলোয়ারহীন শান্তিপূর্ণ মিছিল এর চেয়ে অধিক কিছু মনে করতে পারেন নি সেদিন। সরকারি ছুটিকে উপভোগ করে নেওয়ার চেয়েও বেশি কিছু ভাবনা কলকাতার হিন্দুদের সেদিন হয় নি। পরিকল্পনা মত, ১৬ই আগস্ট দুপুর ৩টের সময় অক্টারলোনি মনুমেন্ট(শহীদ মিনার) এর তলায় প্রায় ১০০০০ সশস্ত্র মুসলমানের জমায়েত হয়। মঞ্চে তখন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী সব নেতারা। তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হুসেন শহীদ সুরাবর্দীর উপস্থিতিতেই চলতে থাকে হিন্দুবিরোধী উস্কানি। ধ্বনি ওঠে– শালা হিন্দু লোগোকো মার ডালো, কিংবা কাফের তোদের দিন ঘনিয়ে এসেছে! ‘গুন্ডাদের পালনকর্তা’ নামে কুখ্যাত প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী নিজেও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন– ২৪ ঘন্টা সময় দিলাম, কী করতে পারিস কর!
উল্লেখ্য, এই মিটিং এ আমন্ত্রিত ছিল দলিত হিন্দু, খ্রিস্টানরাও।
দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এবং কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুকেও মঞ্চে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। যোগেন মণ্ডল মন্ত্রিত্বের লোভে সেই মঞ্চে উপস্থিতও ছিলেন তখন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, পাকিস্তান ছিনিয়ে নিতে যে যোগেন মণ্ডল মুসলিম লীগকে প্রত্যক্ষ সমর্থন জুগিয়েছিলেন, পাকিস্তান তৈরি হলে সেই যোগেন মণ্ডলকেই লীগ গুন্ডাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে ভারতে পালিয়ে আসতে হয়। নারীলোলুপ লীগ শিয়ালদের হাতেই ছেড়ে আসতে হয় নিজের পরিবারকে! সে এক মর্মান্তিক পরিণতি। যাক। আমরা আবার ফিরে আসি ১৬ই আগস্টের সেই বারুদ-ঠাসা লীগ সভায়।
আরও পড়ুন: তেলেনিপাড়া কাণ্ড…প্রশাসনিক রদবদল, ভদ্রেশ্বরের আইসি নন্দন পানিগ্রাহীর জায়গায় এলেন কৌশিক ব্যানার্জি
যোগেন মণ্ডল পরিস্থিতি না বুঝে মঞ্চে উঠে বসেন। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু প্রলেতারিয়েত সর্বহারা মুসলিম লীগ গুন্ডাদের সমর্থন করার জন্য হাজির হলেও তিনি কিন্তু যোগেন মণ্ডলের মত মঞ্চে আরোহণ করলেন না। বস্তুত, জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক ধুরন্ধরতা গোটা দেশে প্রসিদ্ধ। জ্যোতি বসু পুলিশ প্রহরার মধ্যে প্রথমে সভার গতিপ্রকৃতি আঁচ করার চেষ্টা করলেন। সভার উদ্দেশ্য বুঝতে তাঁর বেশিক্ষণ সময় লাগল না যখন দেখলেন অদূরে চৌরঙ্গীর হিন্দু দোকানগুলোতে আগুন ধরিয়ে সর্বহারার বিপ্লব পরিচালনায় রত মুসলিম লীগের গুন্ডারা! পুলিশি পাহারাতেই দ্রুত বৌবাজারের পার্টি অফিসে পালিয়ে গেলেন জ্যোতি বাবু।
সন্ধ্যার দিকে কয়েকজন কমরেডের সঙ্গে জ্যোতি বসু শিয়ালদা হয়ে লোয়ার সার্কুলার রোডের পার্টি অফিস পর্যন্ত হেঁটে ফেরেন। সেই সময়, বাড়ি ও দোকানগুলো থেকে উথলে ওঠা আগুন, রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ এবং ফুটপাথে ঘোরাঘুরি করা লীগ গুন্ডাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তিনি ‘জনগণের সঙ্গে’ পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ করেছেন। সেদিন মুসলিম কমরেডরা যে লীগের সঙ্গে একযোগে হিন্দু নিধন যজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রমোদ দাসগুপ্ত, নীরোদ চক্রবর্তী কিংবা বঙ্কিম মুখার্জির মত ধুতি পরা হিন্দু কমরেডদের প্রাণ যেতে বসেছিল, সে ঘটনাও কার্যত স্বীকার করে নেন জ্যোতি বাবু। ঘটনা হল, কমিউনিস্ট পার্টির পুরোনো সদস্যরা কলকাতা হত্যাকাণ্ড নিয়ে জ্যোতি বসুর এই বিবৃতি সম্পর্কে জানলেও প্রকাশ্যে কখনোই মানতে চান না। কারণ, অবশ্যই এতে সেই তিনদিনব্যাপী ঘটা হিন্দু নিধন যজ্ঞে মুসলিম লীগের অবদানের স্বরূপ প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে হবে। ‘দাঙ্গা’ বলে চালানো ইতিহাসের কালো অধ্যায়টির ষড়যন্ত্র স্বচ্ছ হয়ে উঠবে মানুষের কাছে। ফলে ক্ষুণ্ন হবে মাতৃভূমি পাকিস্তানের প্রতি দায়বদ্ধতা!
বর্তমানে, ‘লালচে গুয়েভরা’র কিউট মুখওয়ালা গেঞ্জির টানে রাতারাতি কমরেড হয়ে যাওয়া যুবক-যুবতিদের কাছেও সেই অভিশপ্ত অধ্যায়টি অজ্ঞাত। পূর্বজদের আউড়ে যাওয়া পাকিস্তান ও মানবতাবাদের ভাঙা ক্যাসেটের ভিতরের লক্ষ লক্ষ হিন্দুর অশ্রু ও রক্তে ভেজা রিলটির আবেদন তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। বলা ভালো করানো হয় না।
ইতিহাসকে বদলানো যায় না। তবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহান ৭ বার (মতান্তরে ১৬ বার) মহম্মদ ঘোরীকে প্রাণভিক্ষা দেন। কিন্তু ঘোরী পৃথ্বীরাজকে একবার হাতের মুঠোয় পেয়েই তাঁর দুচোখ উপড়ে নেয়। পৃথ্বীরাজ চৌহানের মর্মান্তিক ইতিহাসকে বদলানো সম্ভব নয়, তবে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যিক। ইতিহাস পৃথ্বীরাজকে ক্ষমা করেনি, কাউকেই করে না। বরং, ইতিহাস বজ্রকণ্ঠে সতর্ক করে চলে।
এই প্রতিবেদনের সম্পূর্ণ মতামত লেখকের