করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই হবে ৯০০ বছরের প্রাচীন কাঁকসার বনকাটির রায় পরিবারের শ্মশান কালীপুজো

জয়দেব লাহা, দুর্গাপুর: বদলে গেছে রাজত্ব। জৌলুস কমেনি পুজোর। ভগ্নপ্রায় মন্দিরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চলছে সংস্কারের কাজ। কাঁকসার বনকাটির রায় পরিবারের শ্মশান কালীপুজো এখন চিরাচরিত প্রথা মেনেই পূজিত হয়। তবে এবার করোনা আবহে স্বাস্থবিধি মেনেই হবে মায়ের পুজো।
বনকাটি রায় পরিবার। রাজা বল্লাল সেনের কুল গুরুর বংশধর। কথিত আছে রাজার আমলে ঘন জঙ্গল কেটে গ্রাম তৈরি হয়। তাই বনকাটি নামকরণ। রাজা বল্লাল সেন বাংলাদেশ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দীক্ষাগুরু তান্ত্রিক আচার্য মহেশ্বর প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে কাঁকসার গড়জঙ্গলে রাজ্যপাট শুরু করেন। অজয় নদী মাধ্যমে ব্যাবসা বাণিজ্যে সুবিধার্থে বনকাটি গ্রাম পর্যন্ত চ্যানেল খাল তৈরি করেন। বনকাটি এলাকা থেকে লাক্ষা ও কাঠ কয়লা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হত। এবং সেখান থেকে মশলাপাতি নিয়ে আসা হত। এককথায় বনকাটি ছিল রাজা বল্লাল সেনের বাণিজ্যিক কেন্দ্র। পানাগড়- মোরগ্রাম রাজ্য সড়কের এগারো মাইল মোড় থেকে পশ্চিম দিকে অজয় নদীর লাগোয়া বনকাটি গ্রাম।
তৎকালীন সময়ে রাজার কুল গুরু মহেশ্বর প্রসাদ ওই গ্রামেই শ্মশান কালীপুজো শুরু করেন। সম্পূর্ণ তান্ত্রিক মতে পুজো করতেন। কথিত আছে ছাগ, মেষ ও মহিষ বলির পাশাপাশি ওই সময় নরবলিও দেওয়া হত। যদিও বর্তমানে সেসব প্রথা উঠে গেছে। তবে পরিবারের একজন একফোঁটা রক্ত নিবেদন করেন। পরবর্তীকালে মহেশ্বর প্রসাদের বংশধর ব্রিটিশ সঙ্গে কোন মামলায় ডিগ্রি পায়। তখন ব্রিটিশদের কাছ থেকে রায়বাহাদুর খেতাব পায়। আর তারপর থেকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদলে রায় পদবি হয় আচার্যের বংশধরদের। এছাড়াও রায় পরিবারের পূর্ব পুরুষরা যাতে জল পায়, তার জন্য তাদের নামে পাঁচটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহেশ্বর প্রসাদের এক বংশধর লক্ষ্মীকান্ত রায়। সেসব মন্দির এখনও রয়েছে। তবে টেরাকোটার নকশার কাজ করা ওইসব মন্দির সংস্কারের অভাবে ভগ্নপ্রায়। একই অবস্থা হয়ে পড়েছিল কালী মন্দিরে। ভেঙে পড়েছিল মন্দিরের চালা। যেখানে রয়েছে পঞ্চমুন্ডী আসন।
চলতি বছর মন্দিরের সংস্কারের কাজ শুরু হয়। ভেঙে মন্দিরে চালা ছাড়িয়ে নতুন করে চূড়া তৈরি করা হয়। চলছে নানান নকশা তৈরির কাজ। রায় পরিবারের বর্তমান বংশধর লালু রায় জানান,” মন্দিরের অতীতের কারুকার্য, নকশা সংস্কার করা হচ্ছে। প্রবেশদ্বারে টেরাকোটার মা দূর্গার নানান অবতারের নকশা থাকবে। চুড়ায় থাকবে পিতলের ঘট। প্রায় তিন ফুটের মতো মাটি চাপা পড়ছে মার্বেল পাথরের উঠোন। সেটা খুঁড়ে বের করা হবে। প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখা হবে।”
পুজোর নিয়মনীতি প্রসঙ্গে রায় পরিবারের প্রবীন বংশধর অনিল কুমার রায় জানান,” তান্ত্রিক মতে এবং পুর্বপুরুষের লেখা পুঁথি দেখে পুজো হয়। পুজো হয়। পুজোয় বসার আগে শ্মশানের কিছু ক্রিয়াকর্ম করতে হয়। তারপর গুরুপুজন এবং মায়ের বারিঘট নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মায়ের নিজস্ব পুকুর জরুলি পুকুর থেকে বারি নিয়ে আসা হয়। নিশিরাতে মায়ের হোম যজ্ঞ করা হয়। রায় পরিবারের নামে ১ হাজার ৮ টি বেলপাতা সংকল্প হবে। যজ্ঞে ৫ কেজি ২৫০ গ্রাম গাওয়া ঘি পোড়ানো হয়। তারপর ভক্তদের ঘি, বেলপাতা থাকে। এছাড়াও পরিবারের একটি ছাগ, একটি মেষ, একটি মহিষ বলি দেওয়া হয়। তারপর ভক্তদের মানত করা ছাগ বলি দেওয়া হয়। সবশেষে নিজের পরিবারের একজনের রক্ত একফোঁটা নিবেদন করতে হয়। তারপর পূর্ণাহুতি দেওয়া হয়।”
আরও পড়ুন: আমিই জিতেছি: ডোনাল্ড ট্রাম্প
অনিলবাবু আরও জানান,”মায়ের মন্দিরে পরিবারের ছাড়া অন্য কেউ রাত্রে থাকতে পারে না। একবার এক তান্ত্রিক মন্দিরে থাকার জেদ করেছিলেন। এবং রাতে শুয়েছিলেন। পরদিন সকালে দেখা যায় মায়ের মন্দিরের বাইরে তিনি পড়ে রয়েছেন।” অনিলবাবুর ছেলে লালু রায় জানান,” কালীপুজোয় নরনারায়ণ সেবা করানো হয়। তাছাড়াও মায়ের নিত্য সেবা হয়। প্রত্যেক অমাবস্যায় হোমযজ্ঞ হয়। তবে এবারে করোনা সংক্রামক রুখতে স্বাস্থবিধি মেনে সব হবে। স্যানিটাইজার থাকবে। মাস্ক বিলি করা হবে। ভিড় সামলাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক করে পূণ্যার্থীদের মন্দির চত্বরে ঢোকানো হবে। প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়া হবে।”