শ্যামাসংগীত রচনার নেপথ্যে কালীসাধক নজরুল

অরিজিৎ মৈত্র: ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধুপকাঠিতে’, ‘যত জ্বালি সুবাস তত ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা, অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে’। এই শ্যামাসংগীত কোনও হিন্দু লেখেননি, লিখেছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক মুসলমান। বর্তমানে যখন সারা দেশ জুড়ে রাম আর রহিমকে নিয়ে মারামারি হানাহানি চলছে, তখন মুসলমান সম্প্রদায়ের একজন কবি যে এই দেশের মাটিতে বসে এই ধরনের গান লিখেছিলেন, ভাবতে বেশ অবাক লাগে। কিন্তু গল্প হলেও এটাই সত্যি। পশ্চিমবাংলার সাহিত্যরসিকদের কাছে তিনি পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম হিসেবে। অনেকেই ভাবতে পারেন যে বিদ্রোহী কবির এ হেন ইচ্ছা হল কেন? তিনি ইসলামি সংগীত, গজল ছেড়ে হঠাৎ কালীকির্তন বা শ্যামাসংগীত লিখতে গেলেন কেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে যাঁকে নিয়ে এইসব ভক্তিসংগীত, সেই দেবী কালীকা সম্পর্কে একটু জেনে নিই। তারপর কাজী সাহেবের শ্যামাসংগীত রচনার নেপথ্যের কারণের দিকে আলোকপাত করব।
বলা হয় মা কালী অথবা শ্যামা মা দশমহাবিদ্যার প্রধান দেবী। দেবী কালীকার প্রতিষ্ঠা এবং সেই রূপের প্রকাশ ও প্রসার এই বাংলাতেই। তিনি কিন্তু কোনওভাবেই আর্য দেবী নন। অবশ্য বর্তমানে কালী সাধনার যে প্রচলন এবং জনপ্রিয়তা তা কিন্তু অতীতে দেখা যেত না। গুপ্ত, সেন এবং পাল বংশের রাজারা যখন সাম্রাজ্য চালাতেন বাংলায়, সেই সময় শাক্তধর্মের চর্চা লক্ষ করা যেত। সেই যুগের কিছু শিলালিপি এবং তাম্রলিপির ওপর পওয়া নারীমূর্তি দেখে শশীভূষণ দাশগুপ্ত সিদ্ধান্তে আসেন যে চর্চা থাকলেও শাক্তধর্মের কোনও প্রাধান্য কিন্তু ছিলনা। দেবীপুজোরূপে শাক্তধর্মকে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত একটি গৌণ ধর্ম বলেই মনে করা হত। অন্যদিকে বেদের রাত্রিসূত্র থেকে জানা যায় যে বৈদিক সাহিত্যে কালী নাম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদ-এ। সেখানে কালী যজ্ঞবহ্নির সপ্ত জিহ্বার একটি জিহ্বা। ‘কালী করালী চ মনোজবা চ, সলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা। স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচী চ দেবী, লেলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বা।’ নানা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে দেবী কালীকা মহাদেবীর রূপ গ্রহণ করেছেন। তন্ত্র পুরাণে মা কালীর একাধিক রূপের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এবার আসি কাজী নজরুলের প্রসঙ্গে। হালিশহরের সাধক-কবি রামপ্রসাদ সেনের পরে নজরুলই একমাত্র কবি যিনি প্রায় ২৪৭টির মত শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন। অন্য এক সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও হিন্দুর আরাধ্যা একজন দেবীর গুণকীর্তণ করার জন্য কেন তিনি এত গান রচনা করলেন, জানতে কৌতুহল হয়। প্রতিটি গানের কী অসাধারণ শব্দবিন্যাস। ‘ভক্তি আমার ধুপের মত উর্দ্ধে ওঠে অবিরত’ বা ‘মার হাসি মুখ চিত্তে ভাসে চন্দ্রসম নীলাকাশে’। এই গানেরই আরও কয়েকটা লাইনের উল্লেখ করলে কাজী সাহেবের লেখনীর মধ্যে ভক্তিভাবের আভাস পাওয়া যাবে। ‘অন্তরলোক শুদ্ধ হল পবিত্র সেই ধুপসুবাসে (ইসলাম ধর্মে একমাত্র মৃত্যুর পরেই ধুপের ব্যবহার করা হয়) / সব কিছু মোর পুড়ে কবে চিরতরে ভষ্ম হবে, মার ললাটে আঁকব তিলক সেই ভষ্মবিভূতিতে’। শোনা যায়, তিনি ছিলেন কালীভক্ত। পারিবারিক নানা প্রতিবন্ধকতা নজরুলকে আরও বেশি কালীনির্ভর করে তুলেছিল। স্ত্রী প্রমীলা কাজীর স্থায়ি আরোগ্য এবং পুত্র বুলবুলের মুত্যু তাঁর মনকে আরও দুর্বল করে তোলে। মুর্শিদাবাদে লালগোলা বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার বরদাচরণ মজুমদার ছিলেন তন্ত্রসাধক। তিনিও ছিলেন কালীভক্ত। তাঁর যোগবলে তিনি কাজী সাহেবের মৃত ছেলে বুলবুলকে দেখাতে পারবেন, এই কথা শোনার পরে নজরুল তাঁর কাছে দীক্ষা নেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কালীসাধনা করতেন। বিষয়টার মধ্যে কোনও হ্যালুশিনেসন ছিলো কিনা জানা যায় নি। স্ত্রীর শারীরিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তিনি কোথায় না গেছেন? পীরের দরগা থেকে ওষুধ সংগ্রহ করেছেন, বিভিন্ন মন্দির থেকেও দৈব্ ওষুধ নিয়ে আসতেন। সেই কারণে একবার তিনি বিশিষ্ট কথা-সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (তারাশঙ্করও ছিলেন তন্ত্রসাধক) কাছে গিয়েও ওষুধ নিয়ে আসেন।
কালীভক্ত এবং সাধক হওয়ার জন্য নজরুল বামাক্ষ্যাপার কাছেও গিয়েছিলেন। তবে শ্যামা মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও নির্ভশীলতা না থাকলে কিন্তু শুধুমাত্র বাহ্যিক ঘটনার প্রভাবে এমন আত্মনিবেদনের গান লেখা সহজ নয়। শ্যামাসংগীতের যে দর্শন, তা তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধী করেছিলেন। শুধু গান লিখেই থেমে থাকেননি। সেই সব গানে সুরারোপও করেছেন। ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’ গানটিতে কাজী সাহেব মালকোষ রাগাশ্রীত সুর করেছিলেন। কী অদ্ভুত দর্শন গানের প্রতিটি ছত্রে। ‘জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়, তাহারে ডাকিছে মা কোলে আয়, কোলে আয়, জীবনে শ্রান্ত ওরে ঘুম পাড়াইতে তোরে, কোলে তুলে নেয় মা মরণেরও ছলে।’
তাঁর সৃষ্টিতে তিনি দেবী কালীকাকে তিনরকমভাবে দেখেছিলেন। কন্যারূপে, মাতৃরূপে এবং অশুভনাশিনীরূপে। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ গানটিতে শ্যামার কন্যারূপকেই প্রত্যয় করা যাবে। এই গানেরও একটি লাইনের উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে। ‘পাগলী মেয়ে এলোকেশী নীশিথিনির দুলিয়ে কেশ, নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার যে তার নাইকো শেষ। / সিন্ধুতে মার বিন্দুখানিক ঠিখরে পড়ে রূপের মানিক, বিশ্বে মায়ের রূপ ধরেনা, মা আমার তাই দিগবসন’। এই গানে কাজী সাহেব শ্যামা মায়ের কন্যা এবং মাতৃরূপকেই প্রকাশ করেছেন। তাঁর চেতনায় মাকে শুধুমাত্র দর্শন আর তত্ত্বের মধ্যে আটকে না রেখে করে তুলেছেন ঘরের মেয়ে। পারবারিক প্রতিবন্ধকতা আর অপার কালীভক্তি যে বিদ্রোহীকবিকে কখন কালীসাধকে পরিণত করেছিল তা বোধহয় তিনি নিজেও জানতে পারেননি। অবশ্য এই সব প্রসঙ্গ কি ১৯৭৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে উৎসাহী কিছু মানুষ প্রকাশ করেছিলেন না বাস্তবে ঘটেছিল সেই বিষয়ে কিছু বিতর্ক রয়ে গেছে কিন্তু ইসলামী সংগীত রচনার পাশাপাশি একাধিক বৈষ্ণবকীর্তণ, গজল, শ্যামাসংগীত যে রচনা করেছিলেন তা নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকার কথা নয়। সেই সব শ্যামাসংগীত যে অত্যন্ত উঁচু দরের এবং উৎকৃষ্ট সে বিষয়ও কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না।