কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত সিংহবাহিনীর পুজোয় এখনও আট মণ চালের নৈবেদ্য হয়

বাবলু বন্দ্যোপাধ্যায়, কোলাঘাট: কাঁধে বাঁক নিয়ে ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বরের শিবের মাথায় জল ঢালতে যায়। চিরাচরিত প্রথা আজও বিদ্যমান। কিন্তু এর পাশাপাশি এই তারকেশ্বরে লুকিয়ে আছে বাংলার অতীত ইতিহাসের এক স্মৃতিবিজড়িত অধ্যায়। চন্ডীমঙ্গল রচয়িতা কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত সিংহবাহিনী দেবীর পুজো। দেখতে দেখতে চারশো কুড়ি বছর অতিক্রান্ত। এখনও সেই অতীত ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সেই সময়ে রীতিনীতিকে বর্তমান প্রজন্ম। এখনও আট মণ চালের নৈবেদ্য এই ঘোষ বাড়ির পুজোতে লক্ষ্য করা যায়। আনুমানিক ১৬ শো খ্রিস্টাব্দে এই ঘোষ বাড়ির পঞ্চমুন্ডির সিংহবাহিনী দেবীর প্রতিষ্ঠা। হুগলির আরামবাগ মহকুমার মলয়পুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের ঘর গোয়ালগ্রাম। সেই গ্রামেরই বাসিন্দা ঘোষ পরিবার। এই পরিবারের কৃতি সন্তান ছিলেন খড়গপুর আইআইটি প্রথম ডিরেক্টর বিজ্ঞানী ডাক্তার জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। তারই পূর্বপুরুষ গোপীনাথ ঘোষ, হুগলির গোঘাট থেকে এই ঘর গোয়ালগ্রাম এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেই সময় ঘোষ বাড়িতে এসে সিংহবাহিনীর প্রতিষ্ঠা করেন কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে জানা যায় তারা ছিলেন বৈষ্ণব। বাড়িতে রাজরাজেশ্বর নারায়ণ মন্দির রয়েছে। পরবর্তী বংশ রক্ষার জন্য শুরু হয়েছিল এই সিংহবাহিনী পুজো। সেই থেকে আজও হয়ে আসছে। অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বছরের-পর-বছর কিন্তু কবির হাত ধরে যে পুজোর সূচনা সেই পুজোর এখনও ছেদ পড়েনি। কিছু নিয়ম বদলালেও পুজোর মূল আচার-অনুষ্ঠান একই রয়ে গেছে। ৪০০ বছর আগে ঘড়ি ছিল না। পুজোর তিথি আচার গুণা হত জলঘড়ি দিয়ে। জলের উপর বসানো হত একটি পাত্র। সেই পাত্রের গায়ে ছিদ্র থাকতো যা হাঁড়ির জল ওই পাত্রে ভিতরে চুকত, ধীরে ধীরে পাত্রটি জলপূর্ণ হয়ে হাড়ির মধ্যে ডুবে যেত। এই ভাবেই গোনা হত প্রহর। দেবীর পুজো হয় শাক্ত মতে। এই পুজোর পাঁঠা বলি হয়। জলঘড়ির সময় দেখেই প্রহর গুণে সন্ধিপুজোর সময় বলি প্রথা প্রচলন করেছিলেন। তবে বর্তমান এক প্রজন্ম জানালেন, ৭৮ এর বন্যার সময় চারদিকে জলে জলময় হয়ে গিয়েছিল সেই সময় একবারই এই বলি বন্ধ ছিল। তারপর থেকেই আবার সেই পুরাতন বলি প্রথা চালু হয়। এলাকায় এই পুজো খুব জাগ্রত বলে পরিচিত।
আরও পড়ুন:৩০০বছরের ঐতিহ্যে ছেদ! হচ্ছে না গোবরডাঙার জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো
পুজো শুরু হওয়ার আগে পারিবারিক রাজরাজেশ্বর নারায়ণ মন্দির থেকে লক্ষ্মীকে শোভাযাত্রা করে স্থাপন করা হয় সিংহাসনে। সেই শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল নামতে ও দেখা যায়। আর একটা রীতি হল ধূনো পোড়া। পরিবারের মহিলার বড় থেকে ছোট সবাই মাটির সরা নিয়ে সার বদ্ধ হয়ে আসনে বসেন। মাথায় ও দু হাতে সরা নিয়ে শুরু হয় ধুনো খেলা। অতীত ঐতিহ্য কে সামনে রেখে এখনো নৈবেদ্য সিংহ বাহিনীর কাছে দেখা যায়। ঘোষ পরিবারের বংশধর সুদীপ্ত ঘোষ জানালেন, সমস্ত রীতিনীতি এখনও চালু করে রাখলেও ধীরে ধীরে লোকবল কমছে। ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে যে পুজো হয়ে আসছে তাকে রক্ষা করবেই সিংহবাহিনী। তাদের পথ দেখাবে তাদের পূর্বপুরুষের নানা স্মৃতিকথা, তাকে আঁকড়ে ধরেই এবারের পুজোতেও কোনও খামতি রাখা হয়নি।