কথা কোয়োনাকো -গীতিকার অমিয় বাগচী

মনীষা ভট্টাচার্য: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতায় পাতায় যে সব, পদ, কাব্য, তার প্রায় প্রত্যেকটিরই একটি সুর রয়েছে। সভ্যতার আদি পর্বে যখন শ্রুতিই ছিল শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম তখন পদকর্তাদের রচনাকে সুরেই সুরেই বর্ণনা করা হত। পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছে আধুনিক গান। কিন্তু প্রশ্ন হল আধুনিক কী? যা সমসাময়িক, তাই আধুনিক। আর সেই অর্থে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তণ, মনসামঙ্গল পরবর্তী সবই আধুনিক। তবু কাব্য, আধুনিক গানের সময়সীমাকে রবীন্দ্রমৃত্যুর পর থেকেই বিবেচনা করা হয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের গানকে আমরা আধুনিক বলে বিবেচিত করি না। বাংলা ছায়াছবিতে গানের ব্যবহারের সূত্র ধরেই আধুনিক গানের জন্ম। এই আধুনিক গানের দুই কিংবদন্তী গীতিকার অমিয় বাগচী এবং সুরকার-গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
বাবা বিনয়কৃষ্ণ বাগচী আর মা প্রতিভা দেবী। রামমোহন থেকে রাশিয়ান রেভেলিউশান, এসব কিছুর প্রতি আকর্ষণ থাকলেও রবীন্দ্রদর্শনই ছিল তাঁর জীবনদর্শন। গীতিকার অমিয় বাগচী। শিল্পীর লেখা ‘কথা কোয়োনাকো শুধু শোনো’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি জনপ্রিয় গান। এক কথায় বলা যায় যে এই একটি গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এই গান সম্পর্কে প্রখ্যাত কথা-সাহিত্যিক সমরেশ বসু বলেছিলেন, ‘লিরিক রচয়িতা হয়তো গানটি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয়ার সম্পর্কে কিন্তু হেমন্তবাবু গানটি গেয়েছিলেন তাঁর শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে। ঠিক তাই। অমিয় বাগচীর স্ত্রীর নাম ছিল ‘মলীনা’ আর ডাক নাম ছন্দা। সেই বিখ্যাত গানের একটি লাইন হল ‘অশ্রুসজল লিপি ছন্দা’। গানের কথাও সম্ভবত সবার মনে আছে, শিল্পীর কথা তো মনে রাখাই স্বাভাবিক।
কিন্তু লিরিক রচয়িতার কথা কারোরি আজ আর মনে নেই। না থাকাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি আজকের তারিখেই ১৯৭৩ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে চলে গেছেন। তারও আগে রবীন্দ্র আদর্শের অনুসারি মানুষটি স্বেচ্ছায় গান লেখার জগৎ থেকে নিজেই সরে আসেন।
আরও পড়ুন: জনসংখ্যা ৫০, গ্রেট আন্দামানের আদিবাসীদের ১০জন কোভিড পজিটিভ, উদ্বেগ
সেই ঘটনায় একটু বা মনোক্ষুন্ন হয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।অমিয় বাগচীর লেখা গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়াও গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় তালাত মেহমুদ, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীন গুপ্ত, সমরেশ রায়, বেলা মুখোপাধ্যায়, সন্তোষ সেনগুপ্ত প্রমুখ। তাঁর লেখা বিভিন্ন গানে সুরারোপ করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, কমল দাশগুপ্ত প্রমুখ।
অমিয় বাগচীর জন্ম ১৯১৫ সালে বিষ্ণুপুরের মামারবাড়িতে। উত্তর কলকাতার কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়িতে বড় হয়েছেন। অমিয় বাগচীর প্রাথমিক শিক্ষা উত্তর কলকাতার কেশব আকাদেমিতে। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক। স্টোনচিপসের ব্যবসার পাশাপাশি মগ্ন হয়ে থাকতেন বইয়ের জগতে। পেশার বাইরে লেখা ছিল প্রচার বিমুখ মানুষটির নেশা। নিয়মিত লিখতেন ‘মাসিক বসুমতি’, ‘সচিত্র শিশির পত্রিকা’ ইত্যাদিতে। লিখেছেন অজস্র কবিতা। অবশ্যই আপন আনন্দের জন্য, কোথাও প্রকাশের প্রত্যাশায় নয়। বাণিজ্যের প্রয়োজনে সাঁওতাল পরগনার রুক্ষ মাটিতে তাঁর লেখক সত্ত্বা থেমে থাকেনি। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন একাধিক প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প।
অমিয় বাগচী রচিত বহু নাটক অভিনীত হয়েছে আকাশবাণী কলকাতায় ‘রেডিও চাকরী’ প্রবন্ধে অভিনেতা বিকাশ রায় লিখেছিলেন বর্ষার সন্ধ্যায় তিনি এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অমিয় বাগচীদের উত্তর কলকাতার বাড়িতে বসে দেখেছিলেন অমিয়বাবুর গান রচনার মুহূর্ত। সেদিন তিনি লিখছিলেন ‘বাদল মেঘের ছায়ায় ছায়ায়’।
সেই গানে সুর দিচ্ছিলেন হেমন্তবাবু। সেদিন বৃষ্টির মধ্যেই রাত দশটার পরে দক্ষিণের দুই যাত্রী দৌড়ে গিয়ে টু-বি বাস ধরেছিলেন। বিশেষ এই গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আকাশবাণী কলকাতার সংগীতশিক্ষার আসরে শিখিয়েছিলেন।
তাঁদের কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটের সেই বাড়িতে আড্ডায় নিয়মিত আসতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সবিতাব্রত দত্ত, সুপ্রীতি ঘোষ, বিমল চট্টোপাধ্যায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ রায়, বিকাশ রায় প্রমুখ। উপস্থিত থাকতেন অমিয়বাবুর মামাতোবোন আকাশবাণীর সংবাদ পাঠিকা নীলিমা সান্যাল।

১৯৪৩ সালে অমিয় বাগচীর লেখা গান আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের করা সেই সব গানের স্বরলিপি সমৃদ্ধ বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘সঞ্চয়ন’ প্রকাশন সংস্থা থেকে। দু’জনে মিলে বইটির নাম দিয়েছিলেন ‘কলহংস’। অমিয় বাগচীর মারও ছিল সাহিত্য চর্চার নেশা। সংসারের সব দায়িত্ব সামলে লিখতেন। বিখ্যাত ফরাসি লেখক জঁ পল সাত্রের একটি উপন্যাস তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘সাড়া দাও’।
আরও পড়ুন: ফের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল অসম, রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ৩.৪
রবীন্দ্রানুরাগী অমিয় বাগচী ‘রক্তকরবী’-র যান্ত্রিক নামকরণ সম্পর্কে চিঠি লিখেছিলেন কবিকে। তাঁর উত্তরও এসেছিল। কবি লিখেছিলেন, ‘আমার নাটকের সকল পাত্র-পাত্রীদের আলাপের মধ্যে আমার ভাষাই এসে পড়ে, এ নালিশ হয়তো সত্য, তাতে চরিত্রের বিশেষত্বের যে ক্ষতি হয়, ভাবের দ্বারা হয়তো তা পূরণ হয়ে থাকবে।’ শান্তিনিকেতন এবং জোড়সাঁকোর বাড়িতে তিনি কবির সঙ্গে দেখাও করেছিলেন একাধিকবার। প্রবোধকুমার সান্যালের লেখা ‘বনস্পতির বৈঠক’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং চক্ষু পরীক্ষার জন্য মেছুয়াবাজারে অমিয় বাগচীর পিতামহ ডা. কালীকৃষ্ণ বাগচীর কাছে এসেছিলেন।
সম্প্রতি বিহান সংস্থা থেকে অমিয় বাগচীর লেখা গানের সংকলন ‘যদি পড়ে মনে’ প্রকাশিত হয়েছে শিল্পীর জন্মশতবর্ষে। শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের প্রথম আধুনিক গানের রচয়িতা ছিলেন অমিয় বাগচী। গানটি ছিল ‘জীবন নদীর দুই তীরে জাগে’। অনেক লেখাই অসমাপ্ত রেখে অসময়ে হঠাৎ-ই চলে গিয়েছিলেন। আজ তিনি না থাকলেও রয়ে গেছে তাঁর গান আর নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অজস্র লেখা যা হয়তো কোনওদিনই দিনের আলোর মুখ দেখবে না।