মেড ইন চায়না: আর চাই না
সুব্রত চৌধুরী: চিনা পণ্য কি এখনই ভেঙে ফেলতে হবে? বলিউডের পপুলারগান “ধীরে, ধীরে, প্যায়ার কো হঠানা হ্যায়” এর মতো “ধীরে ধীরে চিনা সামান কো হটানা হ্যায়,” এই পথেই এগোবে শুধু ভারত নয়, প্রায় অর্ধেক বিশ্ব।
ভারত সেই রাস্তাটা সমগ্র বিশ্বকে দেখানোর পথিকৃৎ। হোয়াট ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুডে, ওয়ার্ল্ড থিঙ্কস টুমোরো!
চিন থেকে করোনা ভাইরাস-যদিও ইচ্ছাকৃত বলেই বিজ্ঞানীদের একাংশের মত সারা পৃথিবীর ১৮২টি দেশে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছে জীবনযাত্রা আর অর্থনীতি। সমস্ত পৃথিবীর একবড় অংশের কলকারখানা বন্ধ হয়ে এসেছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ খুইয়ে দেশ-বিদেশ থেকে গ্রামের, গঞ্জের, ছোট শহরের বাড়িতে ফিরে এসেছেন কপর্দকশূন্য হয়ে। পাইলট, এয়ারহোস্টেস, কর্পোরেট এক্সিকিউটিভরা কেউ পুরো কাজ খুইয়ে রোজগার বিহীন আর কেউ বা কম-মাইনেতে বাড়িতে বসে (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) কাজ করছেন। সারাদেশ, সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক টালমাটাল।
আর এই ফাঁকে, চিনের অনেক কারখানা জিনিসপত্র তৈরি করে সারা পৃথিবীতে রফতানি করার ঘৃণ্য মতলব নিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথে তৈরি।
এ’ভাবে, যখন সারা পৃথিবীর প্রায় সব দেশের শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে বাড়িতে বসে পড়লে, চৈনিক শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা থাকবে-এই ছিল চিনের প্রিমিয়ার আর কমিউনিস্ট পার্টির গূঢ় অভিসন্ধি।
সেই দূরভিসন্ধি, যাতে আগামীদিনে সারা পৃথিবী চিনেদ্রব্যেরও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যাতে মুখ থুবড়ে পরে সারা বিশ্বের অর্থনীতি, যাতে চিন হয়ে ওঠে পৃথিবীর একমাত্র ব্যাকইয়ার্ড ম্যানুফ্যাকচারিং সেন্টার-সামান্য খেলনা থেকে ৫জি, সব কিছুরই।
চিন এই পরিকল্পনা গত ২৮ বছর ধরেই করছে। অগুনতি চৈনিক মুদ্রা ছেপে, ডলারের সঙ্গে রেনমিনবি কারেন্সি ফিক্সড করে বছর দেশ জুড়ে মেশিন, দেশের সর্বত্র নিংবো, ওসি, চ্যাংচাউ, সুচাও, সেংঝেন-সর্বত্র বড় ফ্যাক্টরি বসিয়ে, গ্রাম থেকে সস্তার শ্রমিক এনে, যথেচ্ছ ইলেকট্রিসিটি সাবসিডি দিয়ে, সুদের হার কম করে, উৎসাহমূলক ইন্সেন্টিভ দিয়ে, কৃত্রিম ভাবে ব্যবসায়িক চাতুরি করে দেশের শিল্পায়ন করেছে। এটা আসলে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার দুর্বৃত্তায়ন।
ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এমনই নোংরা পর্যায়ে পৌঁছে ছিল, যে ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে চিন যে দামে কাঁচা রবার আমদানি করত, সেই রবার থেকে টায়ার বানিয়ে চিন যখন ইন্দোনেশিয়ার মোটর কোম্পানিকে বিক্রি করত, টায়ারের দাম কাঁচা সমপরিমাণ রবারের থেকেও কমদামের হত। কী করে সম্ভব?
চিনের সরকার ওদের রফতানিকারকদের ১০ থেকে ২০% রফতানি মূল্যের ওপর উৎসাহমূলক এক্সপোর্ট সাবসিডি দিত এতো বেশি হারে যে, ইন্দোনেশিয়ান বাজারে কাঁচা রবার দেশের বাইরে পাঠানো লাভজনক ছিল, কেননা সস্তা পড়তো, চিন থেকে টায়ার তৈরি করে সেদেশে আমদানিকরা।
ফলস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ার টায়ার শিল্প মুখ থুবড়ে পড়তে শুরু করল। ঠিক একইভাবে, ভারতের অজন্তা দেওয়াল ঘড়ির কোম্পানি দেশের কারখানা বন্ধ করে চিন থেকে নিয়ে আসতে শুরু করেছে।এরকম করেই বন্ধ হয়ে গেছে সারা ভারতের অজস্র ছোট ছোট ফ্যাক্টরি। সারা পৃথিবীতে এমনি করেই বন্ধ করে দিয়েছে চিনাদের ধূর্তামিতে গড়া বাণিজ্য।
এই আগ্রাসী নীতি শুধু বাণিজ্যে নয়, চিনা রাজনীতির সর্বত্র।জাপান, ভিয়েতনাম,লাওস, থাইল্যাণ্ড, ইন্দোনেশিয়া, তিব্বত, অরুণাচল, লাদাখ-সর্বত্র বিবাদমান বেজিং।সেজন্যই আমেরিকার সেক্রেটারি মাইকপম্পেইও বলেছেন, “চিন একটা দুর্বৃত্তদেশ। It’s a rogue state.” এটা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে আমেরিকা এই প্রথম চিন’কে rogue স্টেট বলে অভিহিত করেছে।
সারা পৃথিবী জুড়ে চিনা পণ্য বিক্রি স্বার্থে “ওয়ানবেল্ট ওয়ান রোড” এর মতো উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্পে বেইজিং মশগুল। ডোকলাম হয়ে শিলিগুড়িরও পর দিয়ে বাংলাদেশেস্থল পথে পণ্য পাঠাবার চতুর পরিকল্পনা। আকসাই চিন দিয়ে পাকিস্তানের গওয়াদার বন্দরের মাধ্যমে মধ্যে-প্রাচ্যের ব্যবসা ত্বরান্বিত করার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। চিন থেকে রাশিয়া হয়ে জার্মানি পর্যন্ত স্থলপথে পণ্য পাঠাবার, সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করে, অবারিত বাণিজ্যের এক সর্বগ্রাসী আর উচ্চাকাঙ্খি নকশা।
চিনেদের পরিকল্পনা এমনই ছিল কাপড়ের যে মাস্ক বানাতে তেমন কোনও টেকনোলজি লাগে না, তা মহামারীর শুরুর দিকে ভারতবর্ষ, আর পরে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের রপ্তানি করেছে এই চিন। কোটি কোটি মাস্ক বানিয়ে প্রস্তুত ছিল।চিন টেস্টিং কিট রফতানি করেছে সারা বিশ্বে, যার অর্ধেক নির্ভরযোগ্য নয়। তাহলে কি এমন যে রোগ ছড়িয়ে বিশ্ববাণিজ্য দখল করার চেষ্টা ছিল? এটা একেবারেই কাকতালীয় হতে পারে না, বেছে বেছে বিশ্বের শিল্পপ্রধান দেশগুলো অজানা করোনা ভাইরাসের আক্রমণের প্রথম শিকার।
“আমরা দেখব কোত্থেকে এই ‘চাইনিজ ভাইরাস’ এসেছে,” বলেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প এই করোনা ভাইরাস ছড়াবার পর। “আমাদের লোকেরা দেখছে।আমাদের বিজ্ঞানীরা, আমাদের গোয়েন্দারা, আমাদের বাকি আরও লোকেরা সব একসঙ্গে দেখছেন।” সে তথ্য আসতে খানিকটা সময় লাগবে।এই পৃথিবী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
আসলে, দুম করে ভারতে সমস্ত চাইনিজ সামগ্রী বন্ধ করা আজকে থেকে যাবে না। দেশের সরকার সেটা বলছেন না। হাতের মোবাইল, বাড়ির টিভি, ল্যাপটপ, বর্ষারছাতা, দেওয়ালিরবাজি, গনেশ পুজোর মূর্তি, দোলেররং, পার্কস্ট্রিটের নিউ ইয়ারের ঝলমলে নীল সাদা আলো — সবই মেড চায়না। যতক্ষণ না এক মোবাইল কোম্পানি ভারতে বসে “মেড ইন ইন্ডিয়া” লোগো দিয়ে বিক্রি করছে, ৪৭ কোটি মোবাইল ব্যবহারকারী ভারতবাসীর আর কোনও বিকল্প নেই।
ততক্ষণ বিকল্প নেই, যতক্ষণ না রাজ্যসরকারের সেই পুরনো টিভি উৎপাদন কোম্পানিগুলো, ওয়েবেল, কোনার্ক, এলকোট, আপট্রনরা LG, Samsung, Hitachi, Sony-র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, আবার টিভি বানাতে শুরু করবে।সরকারি কোম্পানি না পারলে, বেসরকারি কোম্পানির করবে। পারবে? না পারার কিআছে?
যেদেশেরএতগুলো IIT-তে বছরের পর বছর এতো কৃতি স্নাতকরা বেরোয় আর দেশভর্তি ITI-র প্রশিক্ষণপ্রাপ্তছাত্র, সেদেশে একটা টিভিকোম্পানি আবার গড়ে উঠতে পারবে না?
যারা চাঁদে স্যাটেলাইটে পাঠাতে পেরেছে, সেদেশে একটা উন্নত মানের মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, একটা আধুনিক এলসিডি টিভি তৈরির কারখানা গড়ে উঠবে না, সেটা কখনও ভাবা যায়?
এদেশের প্রধানমন্ত্রীর অদম্য, উদ্যমী স্পৃহা আগামীদিনে তাই ভারতবর্ষকে “আত্মনির্ভর” করে গড়ে তুলতে উদাত্তকণ্ঠে ডাক দিয়েছেন। দেশের লোক ধীরে ধীরে চাইনিজ প্রোডাক্ট কেনা থেকে বিরত হতে থাকলেই, চিনে সামগ্রীর চাহিদা কম হয়ে আসবে, আমদানিকারকরা পণ্য আনতে দ্বিধা করবেন। আর এর মধ্যেই দেশের উদ্যোগপতিরা দু’ বছরের মধ্যে বিশ্বমাপের পাঁচ দশখানা কারখানা দাঁড় করিয়ে দেবেন।একটা শিল্প গড়ে তুলতেতো বেশ সময় লাগে, রাতারাতি মাটি ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে যায়, এমনতো নয়, তাইনা?
৯০ এর দশকের পর থেকে, কিছু অনভিজ্ঞ ভারতীয় আমলাদের আর এক বিশেষ দলের রাজনৈতিক নেতাদের কলকাঠিতে আর এক অজানা রাজকীয় পরিবারের অনীহায়, অবারিত হয়ে এসেছে এইভারত চিনে পণ্যের বাজার হিসেবে।
ঠিক একইভাবে, প্রায় হাজার বছর ধরে ভারতে মসলিন কাপড়, বাংলার গ্রামে-গঞ্জে উৎকৃষ্ট কাপড়ের উৎপাদন হয়ে থাকা সত্ত্বেও, ব্রিটিশ বণিকদের ম্যানচেস্টার থেকে আমদানি করে এই বাংলার মাঝারি শিল্পকে ধংস করে দিয়েছিল, যা থেকে বাংলা আর কোনওদিন উঠে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি আজও।
বিদেশি আমদানিকৃত পণ্যের তিনটে শ্রেণী রয়েছে:
১.ওপেন জেনারেল লাইসেন্স, ২. স্পেশাল ইনপোর্টেড লাইসেন্স, ৩.রেস্ট্রিক্টেড আইটেম।চিন থেকে আসা বেশিরভাগ পণ্যকে দ্বিতীয় ক্যাটেগরিতে শ্রেণীভুক্ত করে দিলেই ভারতে রফতানি করা কঠিন হয়ে পড়বে চিনের।
WTO আর GATT-
নিয়ম মেনে একদেশ আর দেশ থেকে চট করে — যুদ্ধ না হলে-পণ্য আমদানিবন্ধ (embargo) ঘোষণা করতে পারেনা। ভারত তাই আজকেই এই চৈনিক পণ্য আমদানি বন্ধ করতে আইনত অপারগ।
তবে ভারত-চিন যুদ্ধ লেগে গেলে, ভারত সরকার চিন থেকে পণ্য আমদানি সাময়িকভাবে বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারেন। এতে আখেরে দেশেরই অর্থনৈতিক লাভ হবে।স্বল্পমেয়াদ থেকে দীর্ঘমেয়াদে, ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি ভারতীয় শিল্প আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।
কেননা, ভারতের সঙ্গে চিনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৫৮বিলিয়ন আমেরিকান ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকার মতো। মুখ-থুবড়ে পড়া ক্ষুদ্র মাঝারি দেশীশিল্প, মহারাষ্ট্রের গনেশপুজোর মূর্তি থেকে দোলের জৈবিক আবির, সবাই আরেকবার অক্সিজেন পাবে।
আজকের এই আহ্বান নতুন প্রজন্মের ভারতীয়দের ঘুরে দাঁড়াবার আহবান। আজকের এই আহ্বান ভারতীয় শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার।আজকের আহ্বান আগামী প্রজন্মের ভারতে কর্মসংস্থানের অগ্রসূচনা।
তাই আজকের বার্তা আমাদের হাতের চিনে মোবাইল আজ’ই ভেঙে ফেলার একতরফা নির্দেশ।এই ডাক ভালোবেসে, সমগ্র ভারতবাসীর তৈরি হওয়ার আহ্বান, যাতে এই দেশে আবার স্বদেশীশিল্পের বাতাবরণ তৈরি হয়, যাতে আত্মনির্ভর ভারতবর্ষের বার্তা আজ থেকে ছড়িয়ে পড়ে। তাহলেই আগামীদিনে, আগামী ২০ বছরে ভারতীয় শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে এই দেশে হবে, নইলে হয়তো যেতে হবে দুবাই, সৌদিআরব, আর লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসতে হবে, আর না হলে, ন্যূব্জ নতুন প্রজন্মকে কিছু দশকদের মধ্যে হয়তো দেখতে হবে আরবি, ইংরেজদের পর চৈনিকদের সম্ভাব্য এক নতুন আগ্রাসন।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় নবনবরূপে। তাই একমাত্র উপায় প্রতিরোধ, বুদ্ধি আর ভারতীয় স্বাদেশিকতার আবেগের প্ৰবলবেগ।
(মত ব্যক্তিগত)
(লেখক: পেশায় আন্তর্জাতিক এগ্রিবিজনেসে যুক্ত)