
নীলোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়: আমাদের সমাজে ধর্মীয় রীতিনীতি, আচারবিচার নিয়ে বেশ কিছু অহেতুক মনগড়া কুসংস্কার বিদ্যমান। এইসবের উৎপত্তি কোথা থেকে তা আমার জানা নেই, তবে সত্যটা জানানোর দায়িত্ব থেকেই এই লেখাটি লিখবার প্রয়োজন অনুভব করছি। অনেকেই প্রশ্ন করেন এই ‘মল’ মাসে কি শুভ কাজ করা যায়? নতুন কিছু কেনা যায় অথবা শুভ কাজে হাত দেওয়া যায়? আসুন দেখে নিই পঞ্জিকা কী বলছে। বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে ভারত সরকার যে পঞ্চাঙ্গ-শোধন-কমিটি গঠন করেছিলেন, তার মতামত মেনে দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা প্রণয়ন হয় এবং বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা সেটি মেনে চলে। সেই পঞ্জিকায় এই ‘অধিক’ আশ্বিনমাসে কী কী শুভদিনের নির্ঘণ্ট দেওয়া আছে, আসুন দেখে নেওয়া যাক।
শান্তিস্বস্ত্যয়ন এর সাতটি দিন, শিল্পারম্ভের পাঁচটি দিন, দীক্ষার তিনটি দিন, নাট্যারম্ভের ছয়টি দিন, ভূমিক্রয়-বিক্রয়ের দু’টি দিন, ক্রয়বাণিজ্য এবং বিক্রয়বাণিজ্যের যথাক্রমে পাঁচটি ও আটটি দিন, নৌকাগঠন, নৌকাচালন ও নৌকাযাত্রার যথাক্রমে সাতটি, তিনটি ও দুইটি দিন রয়েছে। এছাড়াও হলপ্রবাহের চারটি দিন, ধান্যচ্ছেদন, ধান্যরোপণ ও ধান্যস্থাপনের যথাক্রমে দশটি, একটি ও ছয়টি দিন নির্দেশ করা আছে। দেবতাগঠনের পাঁচটি এবং ঔষধকরণ ও সেবনের নয়টি দিন রয়েছে। বীজবপনের চারদিন ও বৃক্ষাদিরোপণের ছয়টি দিন রয়েছে। ঋণদান ও ঋণগ্রহণের যথাক্রমে তিনটি ও পাঁচটি দিন রয়েছে। এর সঙ্গে দশবিধ সংস্কারের দিন তো থাকবেই। গর্ভাধানের পাঁচদিন, পুংসবনের তিনদিন, সীমন্তোন্নয়নের চারদিন, সাধভক্ষণের চারদিন এবং অন্নপ্রাশনের একটি দিন রয়েছে। এখন যারা চট করে বলে দেন, মল মাসে অমুক কাজ করব না, তারা কি বোকা ভাবেন পঞ্জিকার ব্যাবস্থাপকদের? যজমান তো শাস্ত্রমতেই কাজ করতে চান, তাহলে শাস্ত্র যখন ক্রিয়ার নির্দেশ দিয়েছে, সেখানে উড়ো মন্তব্য যাঁরা করেন তাঁরা শুধু নিজেদের অশিক্ষারই পরিচয় দেন।

এবারে আসি অধিক মাসের ব্যাখ্যায়। বছর দু’রকম, সৌর এবং চান্দ্র । পৃথিবী সূর্যকে ৩৬৫.২৪২২ দিনে পরিক্রমণ করে । বারো মাসের প্রতি মাসে সূর্যের চারপাশে ৩৬০ ডিগ্রির ৩০ ডিগ্রি পথ অতিক্রম করে পৃথিবী। এখন চান্দ্রবর্ষের হিসাব অন্য। চন্দ্র পৃথিবীকে পরিক্রমণ করে এক পূর্ণিমা থেকে পরের পূর্ণিমায় (বা অমাবস্যা থেকে অমাবস্যায়) ২৭.৩ দিনে । এখন এই দু’ই চান্দ্র মাস আর সৌরমাসের হিসেবে গরমিল হয়। সৌরমাসের হিসেব ৩০.৪৩৬৮৫ দিনের আর চান্দ্রমাস ২৭.৩ দিনের। একারণেই প্রতিমাসে পূর্ণিমা প্রায় আড়াই দিন করে এগিয়ে আসে, অর্থাৎ সৌরমাসের মত সংক্রান্তির তিরিশ বা একতিরিশ বা বত্রিশ দিন পরে পরের সংক্রান্তি হয় না। পূর্ণিমা এগিয়ে আসে। একইভাবে হিজরি সনও চাঁদ নির্ভর হওয়াতে রোজার মাসও প্রতি বছর দশদিন করে এগিয়ে আসে।

সৌরমাস ও চান্দ্রমাসের হিসেব মেলাতেই এই অধিক মাসের উৎপত্তি । বছর শেষে ১০.৮৭ দিনের (হিজরি সনে প্রতি বছর এটি মিলিয়ে নেওয়া হয়, তবে সে কারণেই সেই ক্যালেন্ডার ঋতুনির্ভর আর থাকে না, যার ফলে বাদশাহ আকবর বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন) হিসেব মেলে না, যেটি ৩২.৫ মাসে (প্রায় দুই বছর সাত মাস) গিয়ে জমে জমে একমাসের আকার পায়। একেই বলে অধিকমাস বা মলমাস। মার্গশীর্ষ অর্থাৎ অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ পর্যন্ত অধিকমাস হয়না, কারণ তখন উৎসবের সময়। দেবতারা জেগে থাকেন। ইহুদিদের ক্যালেন্ডারে আহ-দাহ্র মাসের আগে এই অধিক মাস যুক্ত হয়, আবার বৌদ্ধরা আষাঢ়কেই অধিক মাস করেন। হিন্দু ক্যালেন্ডারে কার্তিক প্রায় অধিক হয় না বলাই ভালো, হলেও তা হয় ২৫০ বছরে একবার।
অধিকমাসের মতন আবার মাস কমেও যায় এই হিসেব মেলাতে। তাও হয় ১৪০ থেকে ১৯০বছরে একবার। খেয়াল করলে বুঝবেন অধিকমাসে এসে অমাবস্যা আর সংক্রান্তি মিলে যায়। এই বছর মহালয়া অমাবস্যা আর ভাদ্রসংক্রান্তি (কন্যাসংক্রান্তিও বলা যায়) একইদিনে হয়েছে। আবার আষাঢ়ে যখন মলমাস হয়, তখন একইমাসে দু’ইটি অমাবস্যা অর্থাৎ অধিক মাসের শুরুর দিন ও শেষের দিনে অমাবস্যা হয়ে থাকে। সেই মাসেই জগন্নাথদেবের নবকলেবর প্রস্তুত হয়ে থাকে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে। অধিকমাসের ক্ষেত্রে আরেকটি মজা দেখবেন। একই বাংলা মাসে দুইটি অমাবস্যা আর একই ইংরিজি মাসে (অধিকমাসের অর্ধেক থেকে যে ইংরাজি মাসটি শুরু হয়) দুইটি পূর্ণিমা। এই বছর তাই অধিক আশ্বিনে দু’ই অমাবস্যা। অক্টোবরে দুই পূর্ণিমা।

আরও পড়ুন:আমাদেরও চাকরি চাই, প্যাকেজ চাই… নিজেদের ‘মাওবাদী’ দাবি করে আন্দোলনের প্রস্তুতি!
এইবার আসি দেবীপক্ষ ও শারদ নবরাত্রির কথায়। এই বছর ১৬ সেপ্টেম্বর দিবা ১১টা ৩১ গতে সৌর আশ্বিন মাস শুরু হয়েছে কারণ, সূর্যের সংক্রমণ হয়েছে কন্যারাশিতে। এখন মহালয়া অমাবস্যা তিথি শেষ হয়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট গতে। এইসময় থেকেই মলমাসের শুরু হল। মহালয়ার পার্বণশ্রাদ্ধ করেই পিতৃপক্ষের নিবৃত্তি হল। ১৬ অক্টোবর রাত্রি ১টা ১ মিনিট গতে অমাবস্যা শেষ হলে শারদ নবরাত্রির সূচনা, দ্বিতীয় কল্পে শারদীয়া দুর্গাদেবীর প্রতিপদাদি কল্পারম্ভ।

এখন অনেকে প্রশ্ন করছেন যে, অধিক মাস যদি শুভই, তবে দুর্গাপুজো কেন পিছিয়ে গেল? সেক্ষেত্রে উত্তর এই, যে হিন্দু পূজা পার্বণ হয় চান্দ্র তিথি অনুযায়ী। অধিক আশ্বিনের পর চান্দ্র আশ্বিন তো পড়বেই। তখনই হবে তিথি মিলিয়ে দুর্গাপুজো। এই মাসভর চলছে দেবীর অধিক পুজো। কৃষ্ণানবম্যাদি প্রথমকল্পের পুজো যাঁরা শুরু করেছেন তাঁরা এই অধিকমাস ধরে নিত্য কল্পারম্ভের ঘটে দেবীর (দুর্গাপূজার সময় যে ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভের ঘটকে লোকে ‘গণেশ ঘট’ বলে ভুল করে অভিহিত করেন) পুজো করে চলেছেন। পঞ্জিকা খুললেও এই মাসের দু’ই পক্ষে দেবীর প্রতিটি তিথির অধিকপুজো বিহিত রয়েছে। অর্থাৎ অধিকমাসের বছরে আপনাকে বেশি প্রার্থনা করে দেবীকে জাগাতে হবে। নিদ্রাভিভূত বিষ্ণুর যোগনিদ্রা ভাঙ্গাতে দেবীকে জাগিয়েছিলেন ব্রহ্মা। সেইভাবে এই বছর বেশি করে দেবীকে ডাকতে হবে। অতিমারীর বছরে তো স্বাভাবিকভাবেই তা করতে হবে। শুভ শক্তির উদবোধন করতে বেশি পরিশ্রম তো করতেই হবে। কিন্তু এই মাসে তিথিকৃত্য (নির্দিষ্ট তিথি মেনে যে কাজ হয়, যেরকম চান্দ্র মাঘের শুক্লা পঞ্চমীতে সরস্বতী পুজো) না হলেও, শুভকর্মে কোনও বাধা নেই। এই মাস সাধনার, ক্রিয়ার, যোগের।

আরও পড়ুন:নারী নির্যাতন, যৌনহেনস্থা, ধর্ষণের ঘটনায় কড়া পদক্ষেপ, সব রাজ্যকে নির্দেশিকা কেন্দ্রের

বশিষ্ঠ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই অধিক মাস হল ‘পুরুষোত্তম’ মাস। স্বয়ং বিষ্ণু এই মাসের নামকরণ করেছেন। এই মাস সাধন ভজন, তীর্থ, ব্রত, পারায়ণ, মন্ত্রজপ ইত্যাদির সময়। নেপালের মাচ্ছেগাঁও-তে অধিক মাস ব্যাপী মেলা হয়। মহারাষ্ট্রের পুরুষোত্তমপুরী গ্রামে বিশাল মেলা ও উৎসবের আয়োজন হয়। সেই মন্দির নিয়ে অনেক কিংবদন্তিও রয়েছে।
সে যাই হোক, অধিক সময় পেয়েছেন অভীষ্ট সাধনে। অতএব ইষ্ট অনুযায়ী সেই সাধন করতে হবে। বারোমাসের বছরে একটি মাস অতিরিক্ত। তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালেই আনন্দ। শাস্ত্র অনুযায়ী কর্ম করতে গেলে পঞ্জিকা দেখে নিলেই হয়। খালি চট করে ভুলভাল মন্তব্য করবার আগে একটু জেনে নিন, বুঝে নিন।