
ভাস্করব্রত পতি, তমলুক: ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে / সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে। / আমলকী বন কাঁপে যেন তার / বুক করে দুরু দুরু / পেয়েছে খবর পাতা খসানোর / সময় হয়েছে শুরু। / শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এলো / টগর ফুটিল মেলা / মালতীলতায় খোঁজ নিয়ে যায় / মৌমাছি দুই বেলা’। এভাবেই শরতের বর্ণনায় উঠে এসেছে শিউলির অনুষঙ্গ। শরৎ আর শিউলি যেন পিঠোপিঠি দুই সহোদর। শরৎ আসার খবর জানান দিয়ে যায় মাটির বুকে শিউলির বিছানা। ‘ঋণ শোধ’ এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কারণেই লিখেছেন, ‘হৃদয়ে ছিলে জেগে, / দেখি আজ শরৎ মেঘে / কেমনে আজকে ভোরে / গেল গো গেল সরে / তোমার ঐ আঁচলখানি / শিশিরের ছোঁওয়া লেগে। / কী যে গান গাহিতে চাই, / বাণী মোর খুঁজে না পাই। / সে যে ঐ শিউলিদলে / ছড়াল কাননতলে, / সে যে ঐ ক্ষণিক ধারায় / উড়ে যায় বায়ুবেগে’।
শরতের পরিচয় কাশ আর শিউলির মেলাতে। অদ্ভুত দ্যোতনা তৈরি করে এঁরা – ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা / নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা’। দিনের আলোতে শিউলি তাঁর উজ্জ্বলতা হারায়। তাই শিউলিকে বলা হয় “Tree of Sorrow” বা ‘দুঃখের বৃক্ষ’। এঁর বিজ্ঞান সম্মত নাম Nyctanthes arbor-tristis। ল্যাটিন পরিভাষায় Nyctanthes-এর অর্থ হচ্ছে ‘সন্ধ্যায় ফোটা’ এবং arbor-tristis-এর অর্থ হোল ‘বিষণ্ন গাছ’। সন্ধ্যায় ফোটা আর সকালে সূর্য ওঠার আগেই ঝরা ফুলের মাঝে বিষণ্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটাই এই রকম নামকরণের কারণ বলে মনে করা হয়। ‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল / রাতের বায় কোন মায়ায়, আনিল হায় বনছায়ায়’।
সূর্যোদয় হওয়ার আগেই শিউলি আর ডালে থাকে না। ঝরে পড়ে মাটির বুকে। যেন তাঁর মরণ ঘনিয়ে আসে দিনের আলোয় – ‘যে কথা রয় প্রাণের ভিতর অগোচরে / গানে গানে নিয়েছিলে চুরি করে / সময় যে তার হল গত / নিশিশেষের তারার মতো / শেষ করে দাও শিউলিফুলের মরণ সাথে’। কবিগুরুর মতো কাজী নজরুল ইসলামও শরতে হারানো তাঁর প্রিয়াকে অনুভব করে লিখেছেন, ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ / এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই…’।
ঝরা শিউলি কি হারানো প্রিয়ার কথা বলে? তাই বুঝি টুটে যাওয়া সম্পর্কের আঁচল টেনে ধরে উচ্চারিত হয় – ‘আমার নয়ন ভুলানো এলে / আমি কি হেরিলাম হৃদয় মেলে / শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে / শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণরাঙা চরণ ফেলে / নয়ন ভুলানো এলে’।
আরও পড়ুন:লাভ জিহাদের বিতর্ক, বিজ্ঞাপন তুলে নিল গয়না প্রস্তুতকারী সংস্থা
শরতের শিশিরভেজা প্রভাত এলেই শিউলির আবাহনকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্যি কি আছে আমাদের? আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কবির সুরে বলে, ‘দেখো দেখো দেখো, শুকতারা আঁখি মেলি চায় /
প্রভাতের কিনারায় / ডাক দিয়েছে রে শিউলি ফুলেরে / আয় আয় আয়’।
শিউলির প্রচলিত নাম Night Flowering Jasmine, হারসিঙ্গার, কোরাল জেসমিন, প্রজক্তা, রাগাপুস্পি,
পারিজাত, পারিজাতা, পারিজাতাকা, শেফালিকা, খারাপাত্রাকা ইত্যাদি। বাংলায় বলে শিউলি বা শেফালি, মারাঠিতে পারিজাথক, তামিলে পাভাঝা মাল্লি বা পাভালা মাল্লি, সংস্কৃতে হারসিঙ্গারাপুস্পক, রাজানিহাসা, বিজয়া, প্রহার্ষিনী, নালাকুমকুমাকা, অপরাজিতা, ভুথাকেশি, সুকলাঙ্গি, নিশিপুস্পিকা, প্রযক্তি, মালিকা, নিসাহাসা, সীতামাঞ্জারি, বাথারি, সুবাহা, প্রযক্তা, প্রভোলানালিকা, ওড়িয়াতে গঙ্গা শিউলি, হিন্দিতে হরসিঙ্গার বা হরশৃঙ্গার, পারিজাত, মণিপুরীতে সিঙ্গারেই, অসমিয়ায় শেওয়ালি বলে।
রাতের গভীর যবনিকা পতনের পর আলোয় সেজে ওঠে প্রকৃতি। আর কি ঐ তারাদলের মাঝে ঘোমটা পরে লুকিয়ে থাকা যায়? ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো / গহন মেঘমায়ায় বিজন বনছায়ায় / তোমার আলসে অবলুণ্ঠন সারা হোলো / শিউলিসুরভি রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে / মৃদু মর্মরগানে তব মর্মের বাণী বোলো’। শিউলিসুরভি রাত পেরিয়ে ঊষার আলো গায়ে মেখে শরততপনে সিনান করে গাইতে ইচ্ছে করে ‘শরত আলোর কমলবনে / বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে / …. আকুল কেশের পরিমলে / শিউলিবনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুতলে’।
শিউলির ডালে যেন প্রেমের কবিতা লেখা হয় – ‘ধরণীর আঁখি যে শিশিরে ভাসে / হৃদয়কুঞ্জবনে মুঞ্জরিল মধুর শেফালিকা’। সেই কবিতা কোনো নাম না জানা নিরাভরণ প্রেমিকার অথবা স্বপনের বেলাভূমিতে আলুলায়িত কোনও প্রেমিকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। অবশেষে প্রাণের উচ্ছ্বলতায় পরিশীলিত হয় সকালের আকাশ – ‘আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরাণ কী যে চায় / ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো’। এখানেই শান্তি বিরাজ করে। চরম বিরহের জলধারায় স্নাত কবি আপ্লুত হয়ে বলে ওঠেন, ‘তোমার নাম জানি নে, সুর জানি / তুমি শরৎ প্রাতের আলোর বাণী / সারা বেলা শিউলিবনে আছি মগন আপন মনে, / কিসের ভুলে রেখে গেলে আমার বুকের ব্যথার বাঁশিখানি’।
শিউলি আসলে সকালের আলো নিয়ে আসে। বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে আসে। মনের প্রশান্তি নিয়ে আসে। মনপবনের আন্দোলনে কবির আবাহন – ‘ওলো শেফালি , ওলো শেফালি, / আমার সবুজ ছায়ার প্রদোষে তুই জ্বালিস দীপালি’। আর শরতের সুরঝর্ণা স্নাত হয় গোবর নিকোনো শিউলিতলায়। হাজার সুরসঙ্গীতের রাগানুরাগ বর্ষিত হয় এভাবেই – ‘শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে / ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে’।
আরও পড়ুন:বারোয়ারি দুর্গাপুজো বন্ধের দাবিতে মামলা দায়ের হাইকোর্টে
শিউলি ফোটার সময় ফুরোলেই শরতের বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। শীতের মৃদুমন্দ আলিঙ্গন তখন বলতে থাকে – ‘শিউলি ফোটা ফুরলো যেই ফুরলো শীতের বনে / এলো যে / আমার শীতের বনে এলে যে শূন্যক্ষণে’। শীত এলেই শিউলির তখন মুখ লুকোনোর পালা। একটা অব্যক্ত যন্ত্রনায় মোচড় দিয়ে ওঠে শিউলির অন্তরাত্মা – ‘শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে / শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে’।