
রক্তিম দাশ, কলকাতা: বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুর্দিনের বন্ধু ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল মুখোপাধ্যায় পরিবারের পারিবারিক সর্ম্পক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ তাঁর পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে এসে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন শেখ হাসিনা এবং তাঁর স্বামী বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ এবং শেখ রেহানা। বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দিল্লিতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অভিবাবক ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়।
প্রণব মুখোপাধ্যায় এপার বাংলার মানুষ হলেও তাঁর স্ত্রী শুভ্রার ছিলেন বাংলাদেশের নড়াইলের মেয়ে। সেই অর্থে প্রণববাবু ছিলেন বাংলাদেশের জামাই। এই আত্মীক সর্ম্পক শেখ হাসিনার দিল্লি আগমণে পরিনিত হয়েছিল পারিবারিক সর্ম্পকে। ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর পরিবার শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখতেন। শেখ হাসিনার সন্তানদের মাঝে মাঝেই প্রণববাবুর সরকারী বাসভবনে খেলতে দেখা যেত।
নিজের বই ‘ড্রামাটিক ডিকেড’-এর স্মৃতিচারণ করে প্রণববাবু লিখেছেন, ‘দুটি পরিবারের মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু দেখাই হত না, দিল্লির বাইরে পিকনিকেও যাওয়া হত।’ একই ভাবে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও বলেছেন, ‘১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাদের সবসময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন, যেকোনো প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশের ফেরার পরও ওঁনার সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যেকোনো সংকটে তিনি সাহস যুগিয়েছেন।’
সংবাদমাধ্যমে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে প্রণববাবু বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা আমার পরিবারের সদস্য। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের নিষ্ঠুর রাজনীতির পর আমাদের বন্ধনটা সেভাবে তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনার সন্তানদের এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় স্থানীয় গার্ডিয়ান ছিলেন আমার স্ত্রী। বাংলাদেশে গেলে সবসময় জামাই আদরটাই পাই। বাংলাদেশের মানুষের আমার জন্য এই ভালোবাসা সবসময় দেখেছি।’
প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্তিম বন্ধু। আর এই বন্ধুত্বের সূচনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস–এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ: দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামে। তিনি বলতেন,‘ভারত ও বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী নয়; তাদের মধ্যে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত বন্ধন। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি ভারত সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কেননা, আমরা অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও ভৌগোলিক সংহতি ধারণ করি।’ প্রণব মুখার্জির উদ্যোগেই ২০০৭ সালে বাগেরহাটের দুটি উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ২ হাজার ৮০০ ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রণব মুখার্জির পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয় বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বরণের পর যখন দিল্লিতে তিনি নির্বাসিত ছিলেন। সেই সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা আমার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু এবং আমি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে ভারত সহায়তা করেছিল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘প্রকৃত ঘটনা হল, যখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা তাঁকে ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁদের ভর্ৎসনা করে বলি, যখন কেউ বিপদে পড়েন, তখন তাঁকে ত্যাগ করা অনৈতিক।’