রুদ্রাণী রাই: ‘কোভিড ১৯’ নামটা আতঙ্কের যেমন, তেমনি আস্থারও। মহামারীতে যেমন মানুষের জীবন সংশয় তেমনি নতুন সম্প্রীতির বিশ্ব গড়বার জন্য মনে মনে ক্ষীণ আশ্বাসও পেতে পারি। এই বিষয়ে মতামত পোষণ করেছেন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। আমাদের মনের জোর যুগিয়েছেন কিংবদন্তী চলচ্চিত্র অভিনেতা
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়—
এই কোভিড-১৯-এর জন্য এই লকডাউনের সময়ে আপনাদের চলচ্চিত্র শিল্প কতখানি এফেক্টেটেড হবে বলে আপনি মনে করেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : এই সময়ের প্রভাব তো পড়বেই ,চলচ্চিত্র শিল্পের উপর, নিশ্চয়ই,যেমন সমাজের সর্বত্র পড়েছে। সমস্ত কিছুই বন্ধ। আমাদের চলচ্চিত্রের কাজও এখন বহুদিন বন্ধ আছে, শুরুটাও অনিশ্চিত। চলচ্চিত্র জগতে যারা টেকনিশিয়ান আছেন, তাদের জন্য আপনারা সিনিয়ররা কি ভাবছেন? কি মনে হয়? এই মুহূর্তে নিজের জীবনযাত্রা নিয়ে ভাবছি। নিজেকে বাঁচাতে পারলে তখন নিশ্চয়ই ভাবব। আর আমি মনে হওয়ার উপর নির্ভর করে কিছু বলতে চাই না কখনও।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত বলেন:
এই দুঃসময় থাকবে না। মনের জোর, মনের বল আর সচেতনতা থাকলেই আমরা যুদ্ধ জয় করব। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে মানুষ জিতেছে কখনও বুদ্ধি দিয়ে, কখনও শক্তি দিয়ে এবং সগৌরবে জিতেছে। এবারেও মানুষ জিতবে। এই মহামারীর ভাইরাসের দূরভিসন্ধি প্রতিহত করবে মানুষই, একদিন না একদিন। বাঙালি কখনও ভেঙে পড়ে না। যে দেশে রবীন্দ্রনাথের মত মানুষ জন্মেছে, সেখানে আমরা ভয় কেনই বা পাব। তার লেখনি আমাদের শক্তি যোগাবে।
প্রখ্যাত লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেন—
‘দু-বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না’, আমি মনে মনে অনেক বেশি করে বেঁচে থাকব। মনের জোরকে সঙ্গে নিয়ে মানসিক সচেতনতা নিয়ে, আমরা লড়ব করোনার সাথে। আমি বৈশাখকে আহ্বান করেছি ঘরে বসেই। প্রকৃতির পরিবর্তন আমি অনুভব করেছি। তার জন্য বাইরে না গেলেও চলবে। আমরা মনে মনে বাঁচব, সচেতনভাবেই বাঁচব। মনে মনে একে অপরের ভালো ভাবব, যুক্ত থাকব পরস্পর। তাই করোনা আতঙ্ককে জীবনের মন্ত্র কেউ করবো না।
চিরঞ্জীত চক্রবর্তী খুব সুন্দর ভাবে তাঁর একটি লেখা, একটি সৃষ্টি আমাদের সাথে শেয়ার করেন :
আমার মনে হয়, সিরিয়ার সেই তিন বছরের ছোট্ট ছেলেটা বোমায় ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়ে বলেছিল ‘ঈশ্বরকে আমি গিয়ে সব বলে দেব।’ হয়ত সে বলে দিয়েছে, সেই পৈশাচিকতার কথা , সেই পৃথিবীর কথা, যা সবার ছিল শুধু মানুষেরই নয়, পশুপাখিদেরও। বলেছে হয়ত মানুষের বর্বরতার কথা, স্বার্থপরতার কথা, অত্যাচারের কথা। ঈশ্বর হয়ত শুনেছেন, সেই ছেলেটির কথা। ঈশ্বরের তৈরি এই নির্মল, সুন্দর পৃথিবীকে এবার ফিরিয়ে নিতে চাইছেন তিনি। আবার নতুন করে তিনি গড়তে চাইছেন বিশ্ব এবং গড়ে নেবেনও। একদিন না একদিন সব থেমে যাবে ঠিকই। কিন্তু আমরা কি মানুষ হব আবার? আতঙ্ক নয়, এই বিষয়টাই ভাববার সময় এসেছে এখন।
জয় ভট্টাচার্য —
চলচ্চিত্রাভিনেতা ও আমাদের বিখ্যাত বহু সিরিয়ালের জনপ্রিয় অভিনেতা জয় ভট্টাচার্য বলেন, এই সময়টা সত্যিই বিশ্ব মানবজাতির কাছে দুঃসময়। কিন্তু আরও দুর্বিসহ বিষয় হল, ‘অনুদান’। মানুষ সর্বত্র যেভাবে অসহায় মানুষকে অনুদান দিচ্ছে, নিজের গর্বিত ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করছে, সত্যি দুঃখজনক। মানুষ মানুষকে বিপদে সাহায্য করবে এইটাই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এই যে লোক দেখানোর প্রতিযোগিতায় আমরা মেতেছি, তাতে দরিদ্রনারায়ণ সেবা কথাটাও হাস্যকর হয়ে গেছে, আমাদের কাছে। মানুষকে ছোটো করা হচ্ছে পোস্ট দিয়ে। এই অনুদানের ছবি পোস্ট করা বন্ধ হোক। মানুষ, সাহায্যের হাত নিশ্চয়ই বাড়িয়ে দেবে, কিন্তু তারজন্য প্রচারের মাধ্যমে সেজেগুজে নেটওয়ার্কে ছবি দেওয়া, কখনও সমীচিন নয়। রাজনৈতিক নেতাদের বিষয়টা আলাদা। তাদের কোন জায়গায় মানুষ অসুবিধায় আছে, সেটা দেখানোর জন্য পোস্টের দরকার আছে হয়ত। তাই অনুরোধ, জায়গায় জায়গায় প্রচার কমিয়ে মানবিকতার খাতিরে সাহায্য করা হোক।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ও নাট্যভিনেতা দেবশংকর হালদার, তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্যে বলেন ,
এই সময় বিশ্বের সমস্ত বিষয়ের মত নাট্যশিল্পও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কিন্তু এইটা একটা মহামারী। সেখানে মানুষের কোন হাত নেই। তবু আমাদের নিজেদেরই নিজেদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। বহু মানুষ একটা নাট্যশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন। আমাদের, যাদের সামান্য সামর্থ আছে, তারা একটা আর্থিক ফান্ড তৈরি করেছি। উদ্দেশ্য নাটকের মানুষদের, যাদের প্রয়োজন, তাদের কিছু সাহায্য করা। সেই সাহায্য তবে কতদিন চলবে, এখনও নিশ্চিত নই। লকডাউন খুললেও সবকিছু স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। কারণ, প্রেক্ষাগৃহ খুললেও এই মহামারীর আতঙ্ক কাটিয়ে দর্শক সমাগম ঘটবে কিনা বলা শক্ত। যদিও টিভি, সিরিয়ালের, বিষয়টা হয়ত আলাদা। সবাই বাড়ি বসে আনন্দ নেয়। তবুও সেই সব কলাকুশলীদেরও কাজ করতে গেলেও বহু সামাজিক বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। সেক্ষেত্রেও কি হতে পারে বলা শক্ত।
জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী , নচিকেতার কথায়,
আমার যা বক্তব্য, আমার কবিতায় বলেছিল, সবাই জানেন। করোনা মারণব্যাধি অবশ্যই সমস্ত পৃথিবী থেকে বিদায় নিক, সবার মতো আমিও চাই। কিন্তু তার সঙ্গে চাই ন্যায়, অন্যায়ের, স্বার্থপরতা, ভেদাভেদ ,বর্বরতার আতঙ্ক রেখে যাক ,যাতে মানুষের মধ্যে , সচেতনতা পারস্পরিক সহযোগিতা, অর্থাৎ বেঁধে বেঁধে চলার বিষয়টা চিরকাল থেকে যায়। দূর হয় বিদ্বেষ, হিংসা, নিষ্ঠুরতা, এটা জরুরি।
নৃত্যশিল্পী ডোনা গাঙ্গুলি বলেন,
কোয়ারেন্টাইনে এই সময়ে আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের অনলাইন ক্লাস করছি। কারণ, ছোটোরা খেলাধূলা এই সময়ে করতে পারছে না। বাড়িতে বসে অসহ্য হয়ে উঠছে তারা। বড়রাও অনেকেই অবসাদে ভুগছে। এই কোয়েরেন্টাইন উঠে গেলেও আমি বাড়িতে ক্লাস করাব কিন্তু সামাজিক দূরত্ব মেনে। আমার বাড়িতে ক্লাস করাবার সমস্যা নেই। অনেক বড়ো জায়গা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্লাস করাতে পারব ৷ সব গ্রুপগুলোকে ভেঙে ভেঙে ক্নাস করাতে পারব । কিন্তু যেখানে এই সুবিধাটা নেই, সেখানে একটু সমস্যা হতে পারে। তা ছাড়া আমরা যেমন, বর্হিবিশ্বে, অনুষ্ঠান করতে যেতাম, আমন্ত্রণ পেয়ে, সেখানে একটু ভেবেচিন্তে যেতে হবে। কোথায় যাব, সেখানে কোথায় থাকব। সবকিছুই খুব বুঝে চলতে হবে। তবে কবে যেতে পারব ,সেটা বলা সম্ভব নয়। আগের মতন বহুমানুষের সামনে পারমর্ফ করাটা সম্ভব হবে কিনা জানিনা । কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অনুষ্ঠান করবার জন্য আমরা এখন থেকে একটু একটু প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই মহামারীর ফলে যারা আমাদের নাচের জন্য, রকমারি পোশাক বানাতেন, গয়না বানাতেন, তারা নিঃসন্দেহে এফেক্টেড হবেন। তাদের জন্যও আমাদের , শিল্পীদের, ভাবাটা নিশ্চয়ই জরুরি।