
অঙ্কন চট্টোপাধ্যায়: গরমকালের দুপুরবেলা। রবীন্দ্রসরোবর মেট্রোর কাছের কোনও এক রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। তখন কলকাতায় নতুন, একা চলাফেরা করবার কথা ভাবতেই পারি না। আমায় হাত ধরে যে কলকাতা চিনিয়েছিল সেদিনও সঙ্গে সে’ই আছে। একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, ভিড়ের মাঝে হঠাৎ একটা বাঁশির মতন মিষ্টি সুর কানে এল। ট্রাফিকের সিগন্যালে সিগন্যালে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাবার একটা চল শুরু হয়েছিল।
কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা করলেই সেইসব চেনা-অচেনা গানের এক দুইলাইন চকিতে চমকে দিয়ে চলে যেত৷ সেদিন যেই গানটা বাজল সেইটা একটা চেনা গান, ‘দুজনে দেখা হল’…পথসঙ্গীকে শুধোলাম, ‘কে গাইছেন?’ উত্তর এল, ‘মোহর দি। তবে এত পুরনোদিনের রেকর্ড, তোর হয়তো ভাল্লাগছেনা।’ অথচ শুনে দেখলাম ভালোই লাগছে। আসলে, অসাধারণ লাগছে। মোহরদি, মানে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গুরু। সেই সময়কার অল্পবয়সের আমি পুরোনো রেকর্ডের মিষ্টতা বুঝতে অক্ষম, সাধারণত সেইসব অমূল্য সম্পদকে ছি ছি-ই করে থাকি, অথচ এই প্রথম আমার খারাপ লাগবে বুঝে কেউ যখন সেটা জানালো তখন সেইটা শুনেই কিনা জানিনা আমার একটা এত পুরনো রেকর্ডও দারুণ ভালো লাগল।

সেদিন কয়েক লাইন শুনে চলে যেতে হলেও, মোহরের শিলমোহর কিন্তু সেই থেকেই মনে গেঁথে রইল। দু’হাজার চোদ্দ সালের সেই দুপুরের প্যাচপেচে গরমে একটা মধুযামিনীর বিচ্ছেদী গান এইভাবে থেকে যাবে, একটা অসময়ের গান এতখানি দাগ কেটে যাবে তখন বুঝিনি। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেশা সেইদিন থেকেই আসলে লেগে গেল। কথায় বলে, নেশা করতে গেলে নেশা বুঝতে হয়। তখন বুঝিনি, কিন্তু পরে যেই বুঝেছি, তাঁর গাওয়া একেকটি গান এক একভাবে ঝিম ধরিয়েছে৷ রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে প্রিয় মানুষের থেকে শান্তিনিকেতনের গল্প শুনতে শুনতে মোহরের কথা কত শুনেছি। অন্ধকার ঘর আলো করে বেজে উঠেছে ‘রইল কথা তোমারই নাথ’ কিংবা ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে’। দিন গেছে, কলকাতায় বসত বাটি গড়েছি। একটু একটু করে তাঁর গানকেও চেনা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি মোহরকে? চিনতে পারিনি। যাঁকে কখনো দেখিনি, ভবিষ্যতে দেখবওনা, কখনও যাঁর পরশও পাবোনা তাঁকে চিনব কেমন করে! অথচ এই ধুলোমাটির কণিকাকেই তো জানবার কথা এই সময়কার তরুণদের। তাঁদের তৃণের জীবনে মোহরের নম্রতা অবশ্য-শিক্ষণীয়।

আসলেই কেমন ছিল মোহর? জানতে হলে পড়াশুনো ছাড়া উপায় নেই। অগত্যা বই ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হল৷ বই ঘেঁটে কত কী জানলাম! তাও আশ মিটল না৷ তারপর পরিচিত, আত্মীয়বর্গদের ফোন করে জ্বালাতন শুরু করলাম। সেখান থেকেও অনেক তথ্য সংগ্রহ করে সব মিলিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর একটা চেষ্টা চলল আরকি। তার ফলাফলকে এই অল্প কথার জায়গায় লেখবার সুযোগ খুবই কম। কিন্তু তাও বেছে বেছে কিছু লিখতে হলে তাঁর সেই ছোট্টবেলায় মেঠোপথে বনপুলকের ছায়া দিয়ে গুরুদেবের বাসায় ছুটে যাওয়ার কথাই কলমের আগায় সবার আগে বেরিয়ে আসে৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর এমনই সহায় ছিলেন যে অঙ্কে শূন্য পাওয়ায় একবার তৎকালীন অঙ্কের মাস্টারমশাই ধনপতিদা-র নামে গুরুদেবের কাছে নালিশ করে দিয়েছিলেন। সেই বালিকা মোহর একটু একটু করে বড় হল, জীবনে প্রেম এল, ভেঙেও গেল। মোহরের সঙ্গীতপ্রেমের উপরে কেউ উঠতে পারল না। তারপর তাঁর প্রথম রেকর্ড বার হল, গুরুদেব শুনে গেলেন সেই গান৷ গান বেরোবার পর একটি চিঠি এসেছিল, তাতে লেখা ছিল ‘বিশ্রি গলা’। চিরকালের কুণ্ঠিত মোহর সেসব শুনে আরও কুণ্ঠিত হয়েছিলেন।
কুণ্ঠা তাঁর বরাবরই৷ কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে তাঁর চিরকালের ভয়। সঙ্গে ছেলেমানুষিও আছে। সাদাসিদে মাটির মোহর একবার ডানকুনির একটি অনুষ্ঠান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কেবলমাত্র জায়গার নাম শুনে। যে জায়গার নাম ডানকুনি সেইখানে কিছুতেই যাওয়া যায় না। অথচ চুপিসারে ‘একেবারে দ্বিতীয় শান্তিনিকেতন’ বলে তাঁকে সেখানেই যখন নিয়ে যাওয়া হল, সন্ধ্যায় চাঁদের আলো, বাতাস, গাছপালা দেখে তিনি জায়গার নাম না জেনেই উৎফুল্ল। শেষে উদ্যোক্তারা বারবার তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন সেই ডানকুনিতেই এসে গান গেয়ে যাওয়ার জন্য। তখন তিনি বুঝলেন তাঁর পাগলামি।

মোহহীন মোহরের আরও গল্প আছে। ঠগ স্যাঁকরাকে পালিশ করতে দিয়েছিলেন নিজের সব গয়না, সেই গয়না আর জীবনে ফেরত পাননি। তাঁর অলঙ্কার হয়ে আজীবন কেবল সঙ্গীতই থেকেছে। যত্ন করে কত কত শিষ্যকে তৈরি করেছেন। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিন তাঁদের মধ্যে অন্যতমা। এই বন্যাদিরই সাঙ্গীতিক কর্মজীবন শুরু হবার সময় মিথ্যা রটেছে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পক্ষপাতিত্ব করেন তাঁর ছাত্রী বন্যাকে স্থান করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁর যে মানুষ চিনতে ভুল হয়নি তার প্রমাণ বন্যাদির গান, গায়কী। সেদিন দুপুরে যখন প্রথম শুনেছিলাম ‘ দুজনে দেখা হল’ তখন তাঁকে চিনেছিলাম বন্যাদির গুরু বলেই। ব্যক্তি মোহরকে তার অনেক পরে চেনা, কিন্তু সূচনা সেদিনই। আজ তাঁর জন্মদিনে সেই দুপুরটার কথাই মনে পড়ছে, যেদিন আদপেই আমাদের দু’জনে দেখা হয়েছিল, এক মহিরুহর সঙ্গে এক সুরের ছায়ায় মাথা বাঁচাতে চাওয়া তৃণের, যাঁকে সে কখনও ছুঁতে পারবে না, কিন্তু তাঁর গানের শিউলিফুল অঝোরে ঝরবে সেই তৃণের ‘মুখের পরে বুকের পরে’। এই আশীর্বাদ, এই প্রাপ্তি।

যা বলতে পারলাম তা দিয়ে তরুণ পাঠকদের হয়তো তাঁকে সিকিভাগের একভাগ চেনা হবে। আর যা পারলাম না তা যদি এই লেখা পড়বার পর পাঠকবৃন্দের জানতে একটুও ইচ্ছে করে, তা’ই হবে আমার লেখার যথাযথ মূল্য।
গ্রন্থ ঋণ: মোহর, আনন্দধারা
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: স্বাতী ভট্টাচার্য, শ্যামশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্য।