
শরণানন্দ দাস, কলকাতা: বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় এই দিনটিতেই চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বাইরের ঝলমলে রোদেলা সকালের দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে উঠলো কবির ফোটোগ্রাফার শেখর তরফদারের। কবিকে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ সামলাতে পারলেন না শহরের বহু ওঠা পড়ার সাক্ষী প্রৌঢ় চিত্র গ্রাহক। গল্ফগ্রীনের বাড়িতে বসে তিনি বলেন, ‘বালুরঘাট থেকে কলকাতায় এলাম ১৯৬৭ তে। মেজদার ( আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রয়াত চিত্রগ্রাহক অমিয় তরফদার) পার্ক সার্কাসের ওয়েস্টর্্যাণ্ড ( পরে ক্যামেলিয়া) স্টুডিওতে কাজ শিখতে শুরু করলাম। আমাদের স্টুডিওতে ছবি তোলাতে আসতেন প্রখ্যাত বেতার ঘোষক কবি নজরুলের পুত্র কাজি সব্যসাচী। তখন ওঁর এইচএমভি থেকে নজরুল কবিতার রেকর্ড বেরোচ্ছে। রেকর্ডের কভার ফটোর ছবি তুলতে আসতেন আমাদের স্টুডিওতে।’
একটু থেমে বললেন, ‘ একদিন কাজি সব্যসাচীকে সাহস করেই বললাম, কবির ছবি তুলতে চাই। উনি ভরসা দিয়ে বললেন, কোন অসুবিধা নেই । আমার স্ত্রীকে বলে রাখবো, তুমি চলে এসো। সেটা ১৯৬৯ এর মে মাস। একদিন গরমের দুপুরে গেলাম ক্রিস্টোফার রোডের ফ্ল্যাটে। ওঁরা থাকতেন দোতলায়। আমি যখন গেলাম তখন ভাবি( কাজি সব্যসাচীর স্ত্রী) কবিকে খাওয়াচ্ছেন। আমি বাইরের ঘরে বসে। কবির ঘরের দরজার পর্দাটায় সামান্য ফাঁক। সেই ফাঁক দিয়েই কবি খেতে খেতেই আমায় দেখছেন। মাঝে মাঝে হাসছেন। সে হাসিতে শিশুর সারল্য। খাওয়া শেষ হলে ভাবি আমাকে কবির ঘরের ডাকলেন।

আরও পড়ুন: ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’…খুঁনসুটি করার সময়ে ‘পালিত’ সিংহদের হাতেই মরতে হল আশ্রয়দাতাকে
প্রবীণ চিত্রগ্রাহক স্মৃতির সঙ্গে কাটাকুটি খেললেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, ‘ অদ্ভুত দুটো চোখ, যেন মনে হল কবি আমার ভিতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন। আমার কেমন একটা রোমাঞ্চ লাগলো। কবি তখন অসুস্থ, কোন অনুভূতি নেই। আমি ভাবিকে বললাম, ছবি তোলার জন্য ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলে অসুবিধা হবে নাতো! সেদিন কয়েকটা ছবি তুললাম, কিন্তু মনোমতো হলো না। ভাবির অনুমতি নিয়ে পরের দিন আবার গেলাম ছবি তুলতে। কবির স্নান সারা। একটা ফতুয়া আর ধুতিকে লুঙ্গির মতো পরানো হয়েছে। কবি আপন মনে কাগজ টুকরো করে ফেলে দিচ্ছেন। সেদিন নাতি নাতনি, ভাবির সঙ্গে কবির ছবি তুললাম। এর পরেও বেশ কয়েকবার কবিকে দেখতে গিয়েছি। পারিবারিক সম্পর্কের মতো হয়ে গিয়েছিল। তারপর তো কবির পরিবার ক্রিস্টোফার রোডের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। স্মৃতি হয়ে রয়েছে এই ছবিগুলো।’পরম মমতায় ছবিগুলোয় হাত বোলাচ্ছিলেন শেখর। ‘ আত্মারামের কৌটোর’ মতো বড্ড দামি ওই সাদা কালো ছবি। ওই ছবির মধ্যে যে নীরব কবির না বলা বানী লুকিয়ে রয়েছে।