সঙ্কটে রবীন্দ্র আদর্শ…..
অরিজিত মৈত্র: ৭৯ বছর হয়ে গেল রবি অস্তমিত হয়েছে। জীবনের শেষ পর্বের বেশিরভাগ সময়টাই বার্ধক্য এবং অসুস্থতার কারণে সক্রিয়তা কমে এসেছিল। কবির শেষ দিনগুলির দিনপঞ্জি পাওয়া যাবে রাণী চন্দ রচিত ‘গুরুদেব’ ও ‘আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে। অস্তাচলের পথিক রবীন্দ্রনাথের অন্তিম পর্বের আরও কিছু ঘটনা ধরা আছে কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর ‘নির্বাণ’ বইতে। অনেক তথ্য মিলবে নির্মলকুমারী মহলানবীশের ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ। মংপুর অসুস্থতার থেকে সেরে ওঠার পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর সময় শেষ হয়ে আসছে। তবুও কলম থেমে থাকেনি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর দেহে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না সেই তর্ক আজ অর্থহীন। অস্ত্রোপচারের সেই ধকল এবং যন্ত্রণা কবি সহ্য করতে পেরেছিলেন কিনা, সেই সত্য হযত কোনওদিনই জানা যাবে না। একদম শেষ দু’দিন সজ্ঞান লোপ পেয়েছিল।
ডা. নীলরতন সরকার, ডা.বিধানচন্দ্র রায়, সত্যসখা মৈত্রের মত চিকিৎসকরা সব রকম চেষ্টা করেও কবিকে ফিরিযে আনতে পারেননি। অবশেষে বাঙালির জীবনে এসেছিল বাইশে শ্রাবণ। নজরুল লিখেছিলেন, ‘দুপুরের রবি পড়িযাছে ঢলে অস্ত সাগর পারে, শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে দলে’। উশৃঙ্খল, বাঁধভাঙা জনতার উদ্যোগে কবির পার্থিব শরীর জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে পেঁছে গিযেছিল নিমতলা মহাশশ্মানে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ শত চেষ্টা করেও কবির শেষকৃত্যের জন্য সেখানে পৌঁছতে পারেননি। ‘সন্ধ্যার রবি উদিবে প্রভাতে নুতন জন্ম লভি’ এই অঙ্গীকার নিয়েই রবীন্দ্রনাথের মরদেহ অগ্নিতে সমর্পিত হয়।

অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন শেষযাত্রার সেই ছবি ক্যামেরাবন্দি করে রেখেছিল। সেই ছবির নেপথ্যে ধারাবিবরণী করেছিলেন নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী আর আকাশবাণী কলকাতার জন্য নিমতলা ঘাটের আলশের উপর উঠে রিলে করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেই সবই আজ ইতিহাস। কবির স্মৃতিকে অক্ষয় করে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল বিশ্বভারতী। পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিশেষ করে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন কাজ বা সিদ্ধান্ত কি রবীন্দ্রআদর্শের সাক্ষ্য বহন করে? রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে তৈরি হওয়া একাধিক উৎসব বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিযেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সমাবর্তন এখন ইতিহাস। নোবেল পদক রবীন্দ্রভবন থেকে উধাও হয়েছে অনেক বছর আগেই। আজও তার হদিশ মেলেনি।
আরও পড়ুন:বাঙালি আবেগ উসকে দিতে সমারোহে ‘বাইশে শ্রাবণ’ উদযাপনের পরিকল্পনা বিজেপির
শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে আয়োজিত বিভিন্ন উৎসবের প্রার্থনাসভায মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রবীণ আশ্রমিক ছাড়া কয়েকজন মাত্র ছাত্র-ছাত্রীর দেখা মেলে। এই ধরনের দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র দুঃখের নয়, লজ্জারও বটে। এমনও নজিরও আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে বহু অসামাজিক কাজকর্ম অতীতেও যেন ঘটেছে এখনও ঘটে। শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব যে একটা আছে তা বলা যায় না। অবশ্য নিয়মমাফিক প্রতি বছর ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণ পালিত হয়। কিন্তু রবীন্দ্রআদর্শের বিষয়টি সম্পর্কে কর্তা-ব্যক্তিদের মনোভাব বোঝা দায়।

সম্প্রতি বিশ্বভারতীর উপাচার্যে সঙ্গে বৈঠকের পরে জানা যায় যে ঐতিহ্যপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অত্যন্ত নীচে নেমে গেছে। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন এবং প্রয়াত উপাচার্য ড. নিমাইসাধন বসু তাঁর ‘ভগনীড় বিশ্বভারতী’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘বিশ্বভারতীর বিরুদ্ধে এক বড় অভিযোগ হল যে এই বিশ্ববিদ্যালযে রবীন্দ্র-শিক্ষচিন্তা ও আদর্শ বর্জিত হচ্ছে| শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য লুপ্তপ্রায়। আগেকার বিশ্বভারতী আর নেই। এই সব কিছুর জন্যই শেষ পর্যন্ত দায়ী করা হয় প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও ঔদাসীন্যকে। আর ‘প্রশাসন’ বলতেই শেষ পর্যন্ত বোঝায় একজনকে-উপাচার্য। আমার পূর্ববর্তী উপাচার্যরা এবং আমি কেউই এই সমালোচনা, নিন্দা থেকে মুক্তি পাইনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল কেউই এই ব্যর্থতা ও ‘অবক্ষয়’-এর কারণ বিশ্লেষণ করে কয়েকটি কঠোর অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হতে চাননি’।
আরও পড়ুন:গেরুয়াময় নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়্যার, বিলবোর্ডে ভেসে উঠল রাম মন্দিরের ছবি
বাঙালির জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে এখনও অর্থোপার্জনের পথটি প্রশস্ত করে রাখা আছে। গ্রন্থনবিভাগ প্রকাশিত বইগুলির মানও আর আগের মতন নেই। বর্তমান আচার্য মশাইযের এই সব বিষয়ে নিয়ে কোনও গঠনমূলক চিন্তাভাবনা আছে কিনা জানা নেই। তবে এখনও সময় আছে অবস্থা পরিবর্তন করবার। রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত জাতীয় সম্পদকে রক্ষা করার দায়িত্ব যেন সরকারের তেমনই সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। কিন্তু সব থেকে প্রয়োজন নিজেদের মনোভাব পরিবর্তনের। রবীন্দ্রনাথের মত যুগপুরুষকে শুধুমাত্র তাঁর জন্মদিন আর প্রয়াণদিবসের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে সারা বছর তাঁর আদর্শকে মানুষের ভিতর ছড়িযে দেওয়া একটা বিশেষ কর্তব্য। তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে দুর্নীতিকে দূরে সরিয়ে রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি। সেখানকার শিক্ষার মান কিভাবে আরও উন্নত করা যায় সে বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।