
পর্ব ১২
মনীষা ভট্টাচার্য: ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই / আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি, / ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…/ এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?’ – রুদ্র মহম্মদের এই কবিতা পড়ছি, ঠাকুমা এসে বলল, আজ রক্ত থাক, বরং আয় ঠাকুমা-নাতনিতে মিলে গাই ‘আগুন আমার ভাই আমি তোমারই জয় গাই’।এই আগুন ছিল বলেই না সোনার বাংলা ছেড়ে শেষমেশ যেতে বাধ্য হল পাকিস্তানিরা। ঘোষিত হল বিজয় উৎসব। হ্যাঁ। ১৬ডিসেম্বর ১৯৭১ – বাংলাদেশের জনজীবনে এক বিশেষ দিন।সেই দিনটির একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে যার সঙ্গে কলকাতা বেতার ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে ছিল। আজ সেই কথা।
মাউন্টব্যাটনের বদান্যতায় ১৯৪৭ –এ ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীন হল আর অন্যদিকে রাডক্লিফ টানলেন লাইন। দেশভাগ। তৈরি হল পূর্ব পাকিস্তান যা আজকের বাংলাদেশ। দেশভাগের পর থেকেই ওপার বাংলায় শুরু হল ভাষাকে কেন্দ্র করে লড়াই। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিলেন হাজার হাজার যুবক। ধীরে ধীরে সেই যুদ্ধই রূপ নিল মুক্তিযুদ্ধে। আমরা জানি, ভারত সরকার বাংলাদেশের এই সংগ্রামে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিল। এক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কলকাতা বেতারের ‘সংবাদ পরিক্রমা’-য় ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অবিরত এই সংঘাতের ঘটনার পরম্পরা আভাসিত হয়েছে প্রণবেশ সেনের কলমে। শুধু তাই নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক বিবরণীর জন্যও জনপ্রিয় ছিল প্রণবেশ সেনের কলম।
পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যকামিতা, নিষ্ঠুর শোষণ ও সামরিক শাসন রুখতে ষাটের দশকেই আন্দোলন তুলে ধরেন শেখ মুজিবুর রহমান। আয়ুব খানের নির্দেশে ওপার বাংলায় বাংলা-উর্দুর মিলিত এক ভাষা তৈরির ফরমান জারি হল, বেতারে বন্ধ করে দেওয়া হল রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার। ফলত তীব্র ঝড় উঠল। প্রতিবাদ জানালেন পূর্ব বাংলার কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীমহল। জনরোষ থামাতে আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যে মামলায় বন্দি করে রাখা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হল। তারিখটি ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেই সময়ই তাঁকে অভিহিত করা হল ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা তুলে দেন।দীর্ঘ টালবাহানার পর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে নির্বাচন হয় এবং জাতীয়সভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামি লিগ। এর কয়েক দিন পর এক ভারতীয় বিমান ছিন্তাই করে নিয়ে যাওয়া হয় লাহোরে এবং দুদিন পর তা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধবংস করা হয়। এরপরই ভারত তার আকাশসীমার ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়।
৭ মার্চ ঢাকার রমনা ময়দানের এক উন্মুক্ত জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিবুর ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ পরের দিন ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়।২৩ মার্চ শেখ মুজিবুরের নির্দেশে পূর্ব বাংলার সকল ঘরে উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়। মুজিবুর ও আওয়ামিলিগের ওপর ইয়াহিয়া খান দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন এবং পাকিস্তানিবাহিনীর দ্বারা সারা বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়। এই সময় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কলকাতা বেতার কেন্দ্রে চলাকালীন অনুষ্ঠান বন্ধ রেখে ঘোষণা করা হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।’
ঘোষণার পর বাজানো হয়েছিল যন্ত্রসংগীতে নিবদ্ধ সুর ‘চল চল চল ঊর্দ্ধগগনে বাজে মাদল…।’এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আরো একটি ঘটনার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি আগেই আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন দিল্লির দুই পাকিস্তানি কূটনীতিক। ২৬ মার্চ ১৯৭১ – এর পর কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার আনুগত্য প্রকাশ করলে পাকিস্তানি হাইকমিশন রূপান্তরিত হয় বাংলাদেশ হাইকমিশনে। কলকাতা বেতারের ‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানে সেই ঘটনার বিবরণী সহ প্রচার করা হয় ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। আর তারপরই শোনানো হয় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও অংশুমান রায়ের গাওয়া ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনির প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি – বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ কলকাতা বেতার থেকেই গানটি সেদিন পৌঁছেছিল জনতার দরবারে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দুই বাংলার সর্বত্র। সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের কাছে এই গান মৃত সঞ্জীবনীর মতো কাজ করেছিল। উল্লেখ্য এই গান সংবাদ বিচিত্রার তৎকালীন প্রযোজক উপেন তরফদার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে রেকর্ড করে এনেছিলেন। গানটির সঙ্গে টেবিল বাজিয়ে সঙ্গত করেছিলেন দীনেন চৌধুরি ও অশোক রায়।
মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে পাওয়া যায়, ২৫ মে থেকে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার সম্প্রচার। কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সেই বেতার কেন্দ্রই তখন মুজিবনগর। আকাশবাণি আর বাংলাদেশ বেতারকাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে চলল অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের স্বপক্ষে। সেই সময় প্রকশিত হয়েছিল তৎকালীন বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের তথ্যনিষ্ঠ জয় বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা। শুধু পত্রিকা নয় সেই সময় সমগ্র আকাশবাণীই হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী, গণতন্ত্রপ্রেমী এবং অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর – যা বিশেষভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সংবাদে, সংবাদ বিচিত্রায়, সংবাদ পরিক্রমায় এবং রেডিও কার্টুনে।
‘আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর আমাদের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। দেশকে যুদ্ধের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প নেই। ’ – ৩ ডিসেম্বর দিল্লি থেকে জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর এই বেতার ভাষণ প্রচারিত হয়। তারপরের সকল ঘটনাই আমাদের জানা। ১৬ ডিসেম্বর সেই দিন যেদিন বিকেলে বুড়ি গঙ্গার তীরে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাক্ষরিত হল ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার। স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হল বাংলাদেশ। রাষ্ট্রভাষা হল বাংলা। জাতীয় সংগীত হল ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক এই প্রেক্ষাপটই প্রতিষ্ঠিত করেছিল কলকাতা বেতারের সেই সময়ের নানা অনুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য। নিয়মিত কিংবা খুব বেশি সংখ্যায় প্রচারিত না হয়েও সেই সব অনুষ্ঠান মিটিয়েছিল সময়ের দাবি। জয় করেছিল শ্রোতার মন।