fbpx
অন্যান্যঅফবিটকলকাতাবিনোদনহেডলাইন

তরঙ্গ কথা…

পর্ব – ১১

মনীষা ভট্টাচার্য: শীতের দুপুরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে ঠাকুমা আর গুনগুন করছে রবি ঠাকুরের গান। ‘…ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুরহাসি…’। ‘আমার সোনার বাংলা’-র প্রথম সঞ্চারী ধরেছে ঠাকুমা। বুঝলাম ক’দিন বাদে বাংলাদেশের বিজয় উৎসব, তাই ঠাকুমা গুনগুন করছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বেতার এই নিয়ে পাতার পর পাতা লিখতে পারেন আজও সেই সময় বেতারের সঙ্গে যুক্ত থাকা মানুষরা। আমার জন্ম এসবের অনেক পরে। আমার সবটাই শ্রবণ কথা আর অবশ্যই কিছু বইয়ের পাতা কথা। মুক্তিযুদ্ধের নানা খবরের সঙ্গে সম্প্রচারিত হত ‘রেডিও কার্টুন’ শিরোনামের এক অনুষ্ঠান। আজ সেই কথা।

টিভির পর্দায় কার্টুন দেখলেই ঠাকুমা বলে চোখ বন্ধ করে একবার শুনে দেখ একদম অন্যরকম লাগবে। এখন তো আর হয় না। হতো এককালে রেডিওতে। চোখ বন্ধ করে শোনার আনন্দ একরকম আবার দেখা-শোনার মজা আলাদা। সে যাই হোক। মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় রেডিও কার্টুন এবং বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে কলকাতা বেতারের ভূমিকার একটি ছবি পাওয়া যায়। সকালবেলা স্থানীয় সংবাদের পর বাজানো হত রবীন্দ্রসংগীত। তারই আগে ১-২ মিনিটের থাকত রেডিও কার্টুন। সেই সময় বেতারের এই প্রয়াস শ্রোতাদের ভালো লেগেছিল। বেতার কেন্দ্রে আসত রেডিও কার্টুন সংক্রান্ত চিঠিও। তেমনই এক চিঠি তুলে দিলাম আপনাদের জন্য।


‘…ছোটো চিন্তা, ছোটো ছোটো ভাবনা, ক্ষণিক চকিত চেতনা ইত্যাদি নিয়ে লেখা ক্ষণিকা, লেখন বা রুবাই আছে। কাগজের পাতায় কয়েকটি স্বল্প আঁচড় টেনে কার্টুন আঁকা হয়। কিন্তু কাট্টু সাইজ রেডিয়ো কার্টুন এক অন্য জিনিস। কলকাতার রেডিয়োতে দিলীপ সেনগুপ্ত মশায় এ-এক অভিনব মৌলিক ভাবনার আবিষ্কারক।

মিনি পত্রিকায় ছোটো ছোটো লেখা কিছু কিছু দেখেছি। সেগুলি হয় তামাশা, নয় রোমান্টিক। কিন্তু রেডিয়ো কার্টুন যেমন বুদ্ধিমেধা চিন্তা অনুশীলন চকিত বিদ্যুতের মতো খেলা করে, তা যেমন রস মাধুর্যের ব্যঞ্জনায় মনকে নন্দিত করে, কাঁচ কাটা হীরের মতো যার ধার, কতকগুলি কথা বা সংলাপের যে বাণী চিত্র ফোটে, তার দৃষ্টি, অভিজ্ঞতা, মানবিক চেতনার দিক – সব মিলিয়ে অভূতপূর্ব। যতক্ষণ এটি চলে প্রতিটি শব্দ এবং কথা শ্রবণমন পেতে শুনি। শেষ হয়েও শেষ হয় না। চিন্তা চলতে থাকে।’

এই রেডিও কার্টুন শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে। সূচনা লগ্ন থেকেই কার্টুনিস্টের নাম ঘোষিত হত বেতারে। মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠার কিছু পরেও এটি সম্প্রচারিত হয়েছে। তবে প্রতিদিন নয়, ছাড়াছাড়া। ১৯৭৩ – এ ভারত সরকার রেডিও কার্টুনিস্ট দিলীপকুমার সেনগুপ্তকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেন। শুধু সম্প্রচার নয়, বেশ কিছু রেডিও কার্টুন ‘বেতার জগৎ’– এও প্রকাশিত হয়েছিল।

জনপ্রিয়তার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে – এ প্রশ্ন মনে উঠলেই উত্তর মিলছে শব্দ ও কণ্ঠস্বরই অন্যতম কারণ। যে চিঠি উপরে দিয়েছি সেই চিঠিই বলে দিচ্ছে কী ক্ষুরধার ছিল রেডিও কার্টুনের ভাষা। পেনের আঁচড়ে ফুটে ওঠা একটা ছবি কত কিছু বলে দেয়, তাকে সম্পূর্ণ অদর্শনের মাধ্যমে ভাবা মুখের কথা নয়। আরও বিস্ময়কর লাগে যখন পড়ি, শব্দই যে মাধ্যমের প্রাণ সেই মাধ্যমে নিঃশব্দই তুমুল শব্দের ঝড় তুলেছিল এই রেডিও কার্টুনই। মিহিরবাবুর স্মৃতি কথা থেকে ধার নিয়ে বলছি সেই অভিজ্ঞতার কথা।

আরও পড়ুন: ৯৭১ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হচ্ছে নতুন সংসদ ভবন, শিলান্যাস করবেন প্রধানমন্ত্রী

‘…দিল্লির বাংলা সংবাদের পর ওভার নাইটের সহকর্মীকে বিশ্রাম দিয়ে দু’নম্বর স্টুডিয়োয় বসেছি কলকাতা ‘ক’-এর ট্রান্সমিশনে। কিউশিটের পাতায় দেখি সকালের স্থানীয় সংবাদ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের টাইপ করা নির্ঘণ্টের মধ্যবর্তী স্থানে কালির আঁচড়ে লেখা; রেডিয়ো কার্টুন। ডিঊরেশন এক মিনিট।…আলাদা টেপ থাকত তার। কিন্তু সেদিন কোনো টেপই দেওয়া নেই রেডিয়ো কার্টুনের। শুধুমাত্র রবীন্দ্রসংগীতের টেপ বক্সটিতে, পৃথক একটা কাগজে লেখা রয়েছে ওই দিনের রেডিয়ো কার্টুনের ঘোষণার বয়ানটি এবং সেখানে এ নির্দেশও দেওয়া হয়েছে যে, ডিউটি অফিসার এবং অ্যানাউন্সার-অন-ডিউটি যেন কন্ট্রোল রুমকে আগেভাগে জানিয়ে রাখেন প্রকৃত ব্যাপারটা কী ঘটবে, যাতে তারা বিভ্রান্ত হয়ে ফিলার না বাজিয়ে বসেন। এক নম্বর স্টুডিও থেকে স্থানীয় সংবাদ শেষ হতেই দু’নম্বর স্টুডিয়োয় আমার বুথে জ্বলে উঠল লাল আলো।

রবীন্দ্রসংগীতের আগে রেডিয়ো কার্টুন। শুধুমাত্র একটি ঘোষণা – আকাশবাণী কলকাতা। রেডিও কার্টুন।…তারপর পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড পজ। নির্ধারিত সময়ের সেই পজ শেষ হতেই সমাপ্তির ঘোষণা – ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির কৈফিয়ত তলবের জবাবে রাওয়ালপিন্ডি থেকে এই নৈঃশব্দ রেকর্ড করে আনা হয়েছে। অনেক কথাই বলা হয়ে গেল কোনো কথা না বলে । বেতারের মতো একটি শ্রুতিমাধ্যমে এমন নিঃশব্দ নীরবতা উদ্দিষ্ট বিষয়বস্তুকে শ্রোতাদের কাছে আর কখনও এতখানি মুখরতায় কেউ পৌঁছে দিতে পেরেছে কিনা জানি না।’

ক্রমশ চলবে……

Related Articles

Back to top button
Close