এক যুগের অবসান…প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

যুগশঙ্খ ডিজিটাল ডেস্ক: প্রয়াত হলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে এই কিংবদন্তি অভিনেতার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। সোমবার দুপুর ১২.১৫ নাগাদ বেলভিউ নার্সিং হোম থেকে এই খ্যাতনামা অভিনেতার মৃত্যুর খবর জানানো হয়। টানা ৪০ দিনের লড়াই শেষ করে দিকশূণ্যপুরের দিকে যাত্রা করলেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা।
গত ৬ অক্টোবর বেলভিউ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন তিনি। রক্তচাপ ওঠানামা করায় রাতে তাঁকে প্রথমে আইটিইউতে স্থানান্তরিত করা হয়। ভেন্টিলেশনে ছিলেন তিনি। পরপর প্লাজমা থেরাপি হয় বর্ষীয়ান অভিনেতার। কিন্তু করোনা তাঁর মগযাস্ত্রে গিয়ে হামলা করে। কোভিড এনসেফেলোপ্যাথিতে আক্রান্ত হন বর্ষীয়ান এই কিংবদন্তি। যার জেরে ধীরে ধীরে বিকল হ’তে শুরু করে তাঁর স্বাভাবিক স্নায়ুর প্রক্রিয়া। একে একে সংক্রমণ দেখা দেয় ফুসফুস এবং মূত্রনালীতে। বিকল হ’তে থাকে তাঁর কিডনি। বার্ধক্যজনিত কারণে ও একাধিক কো-মর্বিডিটি থাকায় শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হ’তে শুরু করে। যদিও অপরিসীম লড়াই করেন অভিনেতা। পুজোর সময় থেকে অত্যন্ত জটিল হতে থাকে এই কিংবদন্তির শরীরের অবস্থা। প্রথমে ব্যাইপ্যাপ এবং পরে সম্পূর্ণ ভেন্টিলেশনে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। কিডনির সমস্যা ঠিক করতে তিন বার ডায়ালিসিস করা হয় তাঁর। কিন্তু, তারপর শুরু হয় অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। তড়িঘড়ি পোস্ট সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করেন চিকিৎসকরা।
১৪ নভেম্বর কালীপুজোর দিন রবিবার রাতে বেলভিউ নার্সিং হোম থেকে বুলেটিনে জানানো হয়, শেষ ২৪ থেকে ৩০ ঘন্টা কোনও সাড়া নেই অভিনেতার। বাড়ির লোককে মানসিকভাবে প্রস্তত থাকতে বলা হয়েছে।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরে ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এই কিংবদন্তি অভিনেতা। বাবার আবৃত্তি শুনেই ছোটবেলায় তার আবৃত্তির প্রতি উৎসাহ জন্মায়। পরে অভিনয়ের পাশাপাশি আবৃত্তিকার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফিল্মে অভিনয় করার পাশাপাশি নাটকেও অসামান্য দক্ষতার নিদর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। বলা যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।
তাঁর জীবনে সব থেকে বড় টার্নিং পয়েন্ট অস্কার বিজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয়। এই খ্যাতনামা পরিচালকের হাত ধরে অভিনেতার জীবনের পথে উত্থান। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত মোট ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
বাংলা সিনেমা জগতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটি মাইল স্টোন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি যুগের অবসান হল।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত সিনেমাগুলি মধ্যে অন্যতম ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯), ‘অভিযান’ (১৯৬২), ‘চারুলতা’ (১৯৬৪), ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’( ১৯৬৯), ‘অশনিসঙ্কেত’ (১৯৭৩), ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪), ‘ফেলুদা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’(১৯৭৮), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৪), ‘গণশত্রু’( ১৯৮৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), চারুলতা (১৯৬৪), অভিযান (১৯৬২), দেবী (১৯৬০)।
মৃণাল সেন পরিচালিত সিনেমাগুলির মধ্যে ‘আকাশকুসুম’ (১৯৬৫), তপন সিনহা পরিচালিত ‘ক্ষুদিতপাষাণ’(১৯৬০), ‘ঝিন্দের বন্দি’ (১৯৬১), অসিত সেন পরিচালিত ‘স্বরলিপি’(১৯৬১), অজয় কর পরিচালিত ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬৩), ‘পরিণীতা’(১৯৬৯), তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘সংসার সীমান্তে’ (১৯৭৫), ‘গণদেবতা’ (১৯৭৮)। এই কিংবদন্তি অভিনেতা প্রায় ২০০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন।
বাঙালি হৃদয়ে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন অপু, অমল, উদয়ন পন্ডিত, অসীম, সন্দীপ, গঙ্গাচরণ, প্রশান্ত, ক্ষিদদা, ময়ূরবাহন, শ্যাম সুন্দর, ড: অশোক গুপ্ত কিংবা মিস্টার মিত্তির হয়ে।
এই কিংবদন্তি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিল্পী সিনেমা জগতে সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও পদ্মভূষণ ও বঙ্গবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হন তিনি। ফ্রান্স থেকেও সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে।