চিনমুক্ত আত্মনির্ভর ভারত গড়ার পথ…..

শান্তনু হালদার: ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি থেকে নিউক্লিয় সামগ্রী, জৈব রাসায়নিক দ্রব্য থেকে কম্পিউটারের পার্টস, মোটরবাইক-চারচাকা থেকে ছোটদের খেলনা, দীপাবলীর রাতের রং-বেরঙের আলো থেকে কৃষি কার্যের সার, সস্তা মোবাইল থেকে ঔষধ ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি, মিল্ক প্রোডাক্টস থেকে লোহা এবং স্টিল -সর্বত্রই ভারতের বাজার ধীরে ধীরে সুপরিকল্পিতভাবে গ্রাস করেছে চিন।
ভারত যে দ্রব্যগুলি বিদেশ থেকে আমদানি করে তার প্রায় ১৩.৭ শতাংশ (২০১৮ -১ রিপোর্ট অনুযায়ী) চিন থেকে আসে। বিশেষ করে রাসায়নিক সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স ও ঔষধ শিল্পে চিনের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় আমাদের। এর মধ্যে ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদির আমদানি চিন থেকে সব থেকে বেশি হয়, যার মূল্য প্রায় বার্ষিক ২০.৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার।
এখন হঠাৎ করে চিন থেকে আমদানি দ্রব্যাদি বন্ধ হয়ে গেলে কিছু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এত দ্রুত বেড়ে যাবে যে তাতে দেশে মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। আর যদি বিভিন্ন আমদানি করা কাঁচামালের হঠাৎ যোগান বন্ধ হয় সেক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ইলেকট্রনিক্স ও ঔষধ প্রস্তুতকারী শিল্প।
আরও পড়ুন:করোনা জয়ের লক্ষ্যে কলকাতায় প্রথম মেডিকা হাসপাতালে তৈরি হচ্ছে প্লাজমা ব্যাঙ্ক
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত ভারত চিনে অনেক কিছুই রফতানি করে, যেমন-কৃষিজাত দ্রব্য, সুতির কাপড়, টেক্সটাইলস, হস্তশিল্পের দ্রব্যাদি, সিসা, লৌহ আকরিক,তামা, হীরে এবং আরও অনেক পণ্য চিনে রফতানি করে সারাবছর। ভারতে উৎপন্ন হীরের প্রায় ৩৬% রফতানি করা হয় চিনে। কিন্তু তুল্যমূল্য বিচারে দেখলে-চাইনিজ খেলনা, চাইনিজ মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ও ঔষধের দরকারি কাঁচামাল দিয়ে ভারতের বাজারকে চিন কবজা করে রেখেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে চাইনিজ প্রোডাক্ট ভারতীয় মার্কেট অধিগ্রহণ করল কীভাবে? একচেটিয়া মনোপলি তৈরি করল কীভাবে? তার তিনটি কারণ –
১) পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন খরচ চিনে অত্যন্ত কম কারণ কমিউনিস্ট শাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন চিন তাদের শ্রমিকদের খুব কম পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নেয় এবং শ্রমিকরা সেখানে বিদ্রোহ করতেও পারে না। সে ক্ষমতা তাদের হাতে নেই।
২) চিনের বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদন সংস্থাগুলি চিন সরকারের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ছাড় অর্থাৎ সাবসিডি পায়, যার জন্য খুব কম দামে তারা সব কিছু উৎপাদন ও প্রস্তুত করতে পারে ।
৩) চিনা উৎপাদন সংস্থাগুলি এত বিপুল পরিমাণে প্রতিটি দ্রব্য প্রস্তুত করে যে (দা ল অফ ইকোনমিক্স অফ স্কেল অনুসারে ) প্রতি ইউনিট পিছু দ্রব্যের উৎপাদন খরচ অত্যন্ত কম হয়। আর এর জন্য শত শত ভারতীয় স্বাধীন ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা এবং দ্রব্য প্রস্তুতকারক সংস্থা ভারতীয় বাজারে সফল হতে পারছে না।
তাহলে চাইনিজ পণ্য কে ভারতীয় বাজারে ব্যান করে দিলেই তো হয়ে যায়।মোদি সরকার তা না করে শুধু অ্যাপ ব্যান করছে কেন? তার আসল কারণ WTO অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের নিয়ম অনুসারে শুধু ভারত নয়, কোনও দেশী অন্য দেশের আমদানি দ্রব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে না, সে যতই দ্বিপাক্ষিক ঝামেলা থাক। আপনি চিনা দ্রব্য কিনবেন না সেখানে কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে চিনের সমস্ত আমদানি সামগ্রীর উপর ব্যান ঘোষণা করলে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই তা কখনই সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন:আক্রান্ত ৭ লক্ষ ছুঁই ছুঁই, সংক্রমণে রাশিয়াকে টপকে বিশ্বে তৃতীয় ভারত
কিন্তু ভারত সরকার জাতীয় সুরক্ষার কারণ দেখিয়ে বা স্বাস্থ্য সুরক্ষার যথাযথ কারণ দেখিয়ে কিছু বিদেশি সামগ্রীকে ব্যান করতেই পারে,যেমন ধরুন চিনা মোবাইল ব্যান করতে না পারলেও ভারত সরকার যেসব চিনা মোবাইলে আই এম ই আই নাম্বার নেই,সেই সব মোবাইল সংস্থাকে ইতিমধ্যে অনেকদিন আগেই ব্যান করেছে। চিনও অনেক আগে ভারতীয় দুগ্ধজাত দ্রব্য ,স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ক্ষতি করছে এই কারণ দেখিয়ে ভারতীয় মিল্ক প্রোডাক্ট এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।এই নিষেধাজ্ঞার আসল কারণ তারা ভারতকে তাদের বাজারে মনোপলি তৈরি করতে দেবেনা।
এই অবস্থায় ভারত সরকার যদি চিন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর বিভিন্ন মাশুল অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়,বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স ও চাইনিজ খেলনা ইত্যাদি দ্রব্যের উপর, সেক্ষেত্রে চাইনিজ জিনিসের দাম অত্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় ভারতীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন ও প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি ও স্বাধীন উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদন সামগ্রী দিয়ে স্থানীয় বাজার ধরতে আবারও সুযোগ পাবেন।আর ভারতীয় মাটিতে তৈরি দ্রব্যাদি ব্যবহারের প্রচলন বাড়লে ভারতীয় মানুষ আরও বেশি বেশি করে কাজ পাবেন। দেশের যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। তৈরি করা যাবে এক আপাদমস্তক আত্মনির্ভর ভারত।
( শান্তনু হালদার- লেখক একজন কলেজ শিক্ষক)
(মতামত নিজস্ব)