সুপ্রীতিই বাজিয়েছিলেন আলোর বেণু

অরিজিৎ মৈত্র: বেশিরভাগ বাঙালিই তাঁকে চেনেন মহালয়ার ভোরে আকাশবাণী কলকাতা প্রচারিত বিশেষ প্রভাতি অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-তে ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’-র গায়িকা হিসেবে। কিন্তু সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া জনপ্রিয় সব আধুনিক গানের কথা আমরা কজনে মনে রেখেছি? গেয়েছেন অজস্র রবীন্দ্রসংগীত। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর গাওয়া প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড। এক পাশে ছিল ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ আর অন্য পিঠে ‘কে বলে যাও যাও, আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া।’ রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরে রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল। ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। কবি স্বয়ং স্বাক্ষর করে এই রেকর্ডের ছাড়পত্র দিয়ে গিয়েছিলেন।
হুগলির হরিপালে দেশ হলেও সুপ্রীতি মজুমদারের জন্ম হয়েছিল কলকাতার হ্যারিসান রোডে। জ্যাঠা নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন আকাশবাণী কলকাতার অধিকর্তা। সেই সুবাদে বাড়িতে আসতেন গুণিজনেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রমুখ। তাঁরা মাঝে মধ্যে বালিকা সুপ্রীতির গান শুনে মুগ্ধ হন। শৈশবে গান শিখেছিলেন ‘বাসন্তীবিদ্যাবীথিতে’। সেখানে তাঁর সংগীতের শিক্ষকদের ভেতর ছিলেন অনাদি ঘোষ দস্তিদার, নিতাই ঘটক, জগৎ ঘটক, শৈলেশ দত্তগুপ্ত প্রমুখ।

সব রকম গানেই ছিল তাঁর আগ্রহ। রবীন্দ্রসংগীত ছাড়াও শিখেছিলেন নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত, আধুনিক বাংলা গান। কীর্তণ শিখতেন রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে। একদিন রেডিওতে গান গাইবারও সুযোগ এসে গেল। প্রথম গান গাইলেন ১৯৪৩ সালে। শৈশব পেরিয়ে এসে সংগীতকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরলেন। শুরু হল পাবলিক ফাংশন। পাশাপাশি ছায়াছবিতে গান গাওয়ার প্রস্তাব আসতে থাকে। চলচ্চিত্র পরিচালক বিমল রায় ‘তথাপি’ ছবিতে তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘ওগো সাথী মম সাথী’ গানটি। এছাড়াও প্লেব্যাক করলেন ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’, ‘বরযাত্রী’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ইত্যাদি ছায়াছবিতে।
প্রথম প্লেব্যাক করেছিলেন শচীনদেব বর্মণের সুরে ‘অভয়ের বিয়ে’ ছবিতে। ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে দ্বৈতকণ্ঠে গান গাইলেন নায়ক-গায়ক অসিত বরণের সঙ্গে। তাঁর অনেক গানে সঙ্গত করেছেন কালোদা অর্থাৎ অসিতবরণ। সন্তোষ সেনগুপ্ত পরিচালিত রবীন্দ্রনৃত্যনাট্য ‘চণ্ডালিকা’- তে মায়ের গানগুলি ছিল সুপ্রীতি ঘোষের কন্ঠে। অন্যদিকে বেসিক রেকর্ডও প্রকাশ পেতে থাকল। পুজোর সময় প্রকাশিত শারদ অর্ঘ্য-তে প্রতি বছর নিয়মিত গাইতে থাকলেন। একবার শ্যামল গুপ্তের লেখা আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যাযের সুরে গাইলেন ‘বরষ পরে পুজোর ঘন্টা বাজলো রে দেশ জুড়ে’। সেবার খুব বিক্রি হল রেকর্ডটা।
এরই মধ্যে সুপ্রীতি মজুমদার হলেন সুপ্রীতি ঘোষ। পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেন অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে। শ্বশুরবাড়ির লোক সুপ্রীতির সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। দেবকী কুমার বসু পরিচালিত ‘রত্নদীপ’ ছবিতে গান গাইবার সময় ঘটেছিল একটা মজার ঘটনা। ‘এক যে ছিল রাজারকুমার’ গানটি স্টুডিওতে রেকর্ড করার সময় সামনে ছিল মাত্র একটাই মাইক্রোফোন। অতীতে সেটাই ছিল দস্তুর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদেহী আর ছোটখাটো মানুষ সুপ্রীতি ঘোষ। কিছুতেই আর তাঁর মুখ মাইক্রোফোন সামনে পৌঁছতে পারছে না।

শেষে একটা ছোট টুলের ব্যবস্থা করে তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছাকাছি পৌঁছন এবং গান রেকর্ডিং শেষ হয়। সুপ্রীতি ঘোষ তখন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, সেই সময় একবার তাঁর কাছে প্রস্তাব আসে প্রবোধ দে নামক এক ব্যক্তির সুরে গান রেকর্ড করার। কিন্তু তিনি এই নবাগত সুরকারকে চেনেন না। তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানেন না। স্টুডিও থেকে বলা হল এই ব্যক্তি বিখ্যাত গায়ক আচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ভাইপো। পরে যিনি সংগীতজগতে পরিচিত হন মান্না দে নামে।

এবার আসি সুপ্রীতি ঘোষের নন ফিল্ম বাংলা আধুনিক গানের কথায়। বিখ্যাত সব গীতিকার আর সুরকারদের সৃষ্টিকে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ। গীতিকার শ্যামল গুপ্তের লেখা প্রচুর গান গেয়েছেন, তার মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয় ‘ যেথায় গেলে হারায় সবাই’, ‘এই ফুলের দেশে কোন ভ্রমর’, ‘আকাশ যদি না অতো সূদুর হত’ , ‘এই বসন্ত জানালে বিদায়’। তাঁর বিভিন্ন গানে সুর দিয়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, দেবেশ বাগচী, দিলীপ সরকার, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, শৈলেন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। গীতিকার-সুরকার প্রবীর মজুমদারের কথা আর সুরে গেয়েছিলেন ‘ঢেউ ওঠে সাগরে উনমনা প্রহরে’। এই গানটি হয়েছিল সুপার-ডুপার হিট।
সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া বেশিরভাগ গানেই মেলোডির ছোঁয়া পাওয়া যায়। কথা, সুর আর কণ্ঠের এক অপূর্ব মেলবন্ধনে প্রতিটি গান শ্রোতাদের কাছে এক সংবেদনশীল আবেদন রাখত। একমাত্র মহালয়া খ্যাত ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু ছাড়া’, বর্তমান প্রজন্ম সুপ্রীতি ঘোষের কোনও গানের সঙ্গে পরিচিত কিনা বলতে পারব না। তাঁর গাওয়া গানের সিডি বাজারে তেমনভাবে আজ আর পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অনেক জনপ্রিয় গান ইউটিউবে রয়েছে। একালের শ্রোতারা যদি আগ্রহ নিয়ে সুপ্রীতি ঘোষের আধুনিক বাংলা গান শোনেন তবে বাংলা গানের স্বর্ণযুগের আরও একটি দিক উন্মোচিত হবে তাঁদের কাছে।আজ ২৮ আগস্ট শিল্পীর জন্মদিনে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁকে নিয়ে কোনও অনুষ্ঠানই হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু শিল্পীর গাওয়া অজস্র গানেই স্মরণ করা যেতে পারে সুপ্রীতি ঘোষকে।