
পর্ব- ২
মনীষা ভট্টাচার্য: অবশেষে ঠাকুমার ইথার তরঙ্গ থুড়ি ঠাকুমার কাঠের বাস্কর ইথার তরঙ্গ ধরা গেছে। ‘ঠাকুমা-মা-মা-মা, তোমার রেডিও এখন কথা বলছে ঠিক ঠাক। নাও, শোনো। শুরু হবে তোমার অনুরোধের আসর। ‘আজ আকাশের মনের কথা, ঝরো ঝরো বাজে, সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে ।’ এই গান কানে ভেসে আসতে মনে হল, সত্যিই তো আকাশের কথাই তো সারাদিন ধরে সবার ঘরে ঘুরে বেড়ায়। আকাশবাণীতে আকাশের কথা! শুরুর কথা তো গত সংখ্যায় বলেছি। আজ তার পরের ইতিহাস।

১৯২৭ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতার এক নম্বর গারস্টিন প্লেসের বাড়িতে উদ্বোধন হয় ভারতের দ্বিতীয় বেতার কেন্দ্রটির। উদ্বোধক ছিলেন তদানীন্তন গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। স্টেশন ডিরেক্টর হন মি. সি সি ওয়ালি। ভারতীয় অনুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিশিষ্ট ক্ল্যারিওনেটবাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। ঘোষণা ও সংবাদপাঠে নিযুক্ত হন ১৯১১ সালের আই এফ এ শিল্ড বিজয়ী মোহনবাগানের রাজেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। কর্মসূত্রে যোগ দেন রাইচাঁদ বড়াল, হীরেন বসু, নলিনীকান্ত সরকার, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য অর্থাৎ বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বিজন বসু প্রমুখরা।
উল্লেখযোগ্য, ১৯২৮ সালের এপ্রিলে কলকাতা বেতারে প্রথম গান গাইলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সব থেকে বড় কথা বেতারের শুরু থেকেই ছিল নানা বৈচিত্রময় অনুষ্ঠান। স্কুল, কলেজ, ফুটবল, ক্রিকেট, জলসা সব ধরণের অনুষ্ঠানই স্থান পেয়েছে এখানে। ১৯২৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে বেতারের অনুষ্ঠানসূচি জ্ঞাপক পাক্ষিক পত্রিকা ‘বেতার জগৎ’। নামকরণ করেন বীরেন রায়, সম্পাদক ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী।

এখন প্রশ্ন হল, এমন এক কালজয়ী সৃষ্টির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িত হয়েছে কবে থেকে? সাল তামামী বলছে ১৯২৭ সালে মিডিয়াম ওয়েভ দিয়ে যাত্রা শুরু, পরে ১৯৩৩ সালে যুক্ত হয় শর্টওয়েভ, এর ঠিক পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৯৩৮ সালের আগস্টে বসানো হয় ১০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার। এই ট্রান্সমিটার উদ্বোধন উপলক্ষে বেতার জগৎ পত্রিকার ১৬ আগস্ট সংখ্যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা প্রকাশের জন্য উদ্যোগী হন দাদাঠাকুরের সাকরেদ নলিনীকান্ত সরকার। সংগীতবিভাগের সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতন যান এবং কবির একান্ত সচিব সুধাকান্ত রাচৌধুরীকে তাঁর মনের কথা খুলে বলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন অসুস্থ। কবির সঙ্গে দেখা করেও কোনও লাভ হল না, চিকিৎসকের নিষেধ থাকায় কবি কিছুই লিখে দিতে পারলেন না। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরলেও চারদিনের মাথায় নলিনীকান্তের কাছে কবির নিজের হাতে লেখা একটি কবিতা সহ সুধাকান্তবাবুর চিঠি এসে পৌঁছয়। অভিভূত নলিনীকান্ত। ১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসের দ্বিতীয়পক্ষের বেতার জগতে কবিতাটি মুদ্রিত হয়। কোনও শিরোনাম ছিল না। তবে কবিতাটিতে ব্যবহৃত ‘আকাশবাণী’ শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আকাশবাণী নামকরণটি রবীন্দ্রনাথের কবিতানুসারে করা হয়েছিল কিনা এই বিষয়ে মতান্তর আছে। অন্য একটি তথ্য থেকে জানা যায় যে ব্যাঙ্গালোর রেডিও স্টেশনের তৎকালীন অধিকর্তা অধ্যাপক এন কস্তুরী নাকি আকাশবাণী নামটি দিয়েছিলেন।
গুরুদেব শান্তিনিকেতন থেকে ৫ আগস্ট ১৯৩৮ সালে যে কবিতাটি লিখেছিলেন, ‘ধরার আঙিনা হ’তে ঐ শোনো, উঠিল আকাশবাণী, অমরলোকের মহিমা দিল যে মর্ত্যলোকেরে আনি। সরস্বতীর আসন পাতিল, নীল গগনের মাঝে, আলোক-বীণার সভামণ্ডলে, মানুষের বীণা বাজে। সুরের প্রবাহ ধায় সুরলোকে, দূরকে সে নেয় জিনি, কবি-কল্পনা বহিয়া চলিল, অলখ সৌদামিনী। ভাষা-রথ ধায় পূবে-পশ্চিমে, সূর্যরথের সাথে , উধাও হইল মানবচিত্ত, স্বর্গের সীমানাতে।’ গুরুদেবের এই শুভেচ্ছাবাণীতে সবাই খুব খুশি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে বেতারের সঙ্গে কবির অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে যা পরবর্তী পর্বে বলা যাবে।
শুধু কী রবীন্দ্রনাথ, শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বৈজ্ঞানিক প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ২৫ শ্রাবণ ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে লেখা শরৎবাবুর শুভেচ্ছাপত্রে ছিল, ‘বেতার প্রতিষ্ঠান বাঙলা দেশে সুখে দুঃখে ভয়ে ভাবনায় পাঁচ বৎসর অতিক্রম করিল। বেতার জগৎ ইহারই মুখপত্র।…বর্ষার সুবিস্তীর্ণ নদীজলে মলিন জ্যোৎস্না ছড়াইয়া পড়ে। আমি তখন প্রাঙ্গণের একান্তে নদীতটে আরাম-কেদারায় চোখ বুজিয়া বসি। তামাকের ধুঁয়ার সঙ্গে মিশিয়া বেতারের বাঁশির সুর যে মায়াজাল রচনা করে। দু-একজন করিয়া প্রতিবেশি জুটিতে থাকে।….আমার পল্লীবাসরের সাথী এই বেতার বস্তুটির আন্তরিক কল্যাণ কামনা না করিয়াই পারি না।’ অন্যদিকে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর শুভেচ্ছায় লিখলেন, ‘বাঙ্গালী জাতি যে বেতারকে বরণ ক’রে নিয়েছে – এটা খুব আনন্দের কথা। বেতার বৈজ্ঞানিক জগতের নবতম সৃষ্টি।…আমাদের বাঙ্গলা দেশের বেতারও কেবলমাত্র গানবাজনা, আমোদপ্রমোদ পরিবেশন করে ক্ষান্ত হয়নি, নর-নারীর শিক্ষার প্রসারের জন্যও বেতারের পরিচালক মহাশয়েরা যথেষ্ট যত্নবান। বেতারের বয়স আমাদের দেশে পাঁচ বৎসরের পূর্ণতা লাভ করেছে।…বাঙ্গালা দেশের বেতার প্রতিষ্ঠান দীর্ঘায়ু লাভ করে দেশের ও দশের সেবায় নিযুক্ত থাকুক।’

প্রবাদপ্রতিম এই সব মানুষের শুভেচ্ছায় ও আর্শীবাদে সেদিনের কলকাতা বেতার আজও পথ চলছে। কলকাতা ‘ক’, কলকাতা ‘খ’, বিবিধভারতী, যুববানী, এফ এম গোল্ড, এফ এম রেইনবো, আকাশবাণী মৈত্রী – বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় আজ সে বিস্তৃত। একটি ছোট্ট তথ্য জানিয়ে আজকের পর্ব শেষ করব।
১৯৬২ সালের ২ জুলাই উত্তরবঙ্গের কার্শিয়াং-এ আকাশবাণীর একটি বেতারকেন্দ্রের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধন করেন তৎকালীন তথ্য ও বেতার মন্ত্রী গোপাল রেড্ডি। এই উপলক্ষে বেতার মন্ত্রীর অনুরোধে দিল্লি বেতারের কতৃপক্ষ, বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী পঙ্কজকুমার মল্লিককে নিমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণ পেয়ে শিল্পী জানান, বেতার কতৃপক্ষ যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকাশবাণীর উদ্দেশে লেখা অনবদ্য বাংলা কবিতায় সুরসংযোজন করে গাইবার অনুমতি দেন, তবেই তিনি এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করবেন। গোপাল রেড্ডি নিজের প্রচেষ্টায় সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন এবং পঙ্কজবাবু কবির সেই বাংলা কবিতায় আশা-ভৈরোঁতে সুর দিয়ে গানটি উদ্বোধনী সংগীতরূপে পরিবেশন করেছিলেন।

পঙ্কজবাবুর আরও একটি ইচ্ছে ছিল, তাঁর সুর দেওয়া কবির এই রচনা আকাশবাণীর সিগনেচার সং হিসাবে প্রচারিত হোক। যদিও তাঁর এই বাসনা কখনও পূর্ণ হয়নি। তবে গোপাল রেড্ডির সচেষ্টায় তিনি এই গান শিখিয়েছিলেন বেতারের সংগীতশিক্ষার আসরে। কবিগুরুর সঙ্গে বেতারের যে এক অম্ল-মধুর সম্পর্ক ছিল তাই নিয়েই সাজাব পরবর্তী পর্ব।
কৃতজ্ঞতা: কলকাতা বেতার
(পরের অধ্যায় দ্বিতীয় সপ্তাহে)
ক্রমশ…