মেয়েদের শরীর কেন ঢেকে রাখতে হবে?

তসলিমা নাসরিন :জিন্স টিশার্ট পরেছে বলে এক মেয়েকে লোকেরা পিটিয়েছে বাংলাদেশের নরসিংদী রেল স্টেশনে। আমি কিন্তু মোটেও অবাক হইনি। আমি অপেক্ষা করছি সেই দিনটির, যেদিন হিজাব বা বোরখা না পরার অপরাধে রাস্তাঘাটে মেয়েদের পেটাতে পেটাতে হাড়গোড় ভেঙে ফেলবে, আধমরা ফেলে রাখবে, অথবা মেরেই ফেলবে।
পোশাক ব্যাপারটা নিয়ে বেশ ভাবছিলাম কিছুদিন। কান ফেস্টিভ্যালের লাল গালিচায় হাঁটা মেয়েদের পোশাকও দেখলাম। আরও কিছু উৎসবেও মেয়েদের খোলামেলা পোশাক দেখা হলো। তারপর ফেসবুকে লিখলাম এ সম্পর্কে নিজের ব্যক্তিগত মত।
কী লিখেছিলাম আমি ফেসবুকে যে এত তোলপাড় হলো? এত গালাগালি বর্ষণ হলো আমাকে লক্ষ্য করে? লিখেছিলাম—
‘’ সুগোল সুডোল ফার্ম স্তন দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। মেয়েরা স্তন দেখানো, ক্লিভেজ দেখানো জামা পরলে বেশ লাগে দেখতে। সুদর্শন পুরুষেরা যেমন শর্টস পরলে বা সুঠাম বাইসেপ দেখানো স্লিভলেস টিশার্ট, বুকের লোম দেখানো ডীপ ভি-নেক টিশার্ট, বা বোতাম খোলা শার্ট পরলে দেখতে ভালো লাগে, তেমন মেয়েরা কিছুটা নিতম্ব ঝিলিক দেওয়া সুগঠিত পা দেখানো মিনি শর্টস পরলে, ক্লিভেজ বা অর্ধেক স্তন দেখানো, পেট এবং নাভি দেখানো ছোট টপ পরলে দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু আজকাল কী যে হয়েছে, যার স্তন দেখতে ভালো নয়, স্যাগিং, বা প্রায় ফ্ল্যাট, তারাও, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক জগতের সেলেব্রিটিরা বুক-খোলা ড্রেস পরেন। কেন যে পরেন, কী দেখাতে, বুঝি না। আর বিশাল বপুর কুচ্ছিত পুরুষগুলোও আঁটসাঁট জামা পরে চললেন। চোখ সরাতে পারলে বাঁচি!
সমুদ্রতীরে, বা লেকের পাড়ে রৌদ্রস্নান করতে থাকা সুইমিং কস্টিউম পরা ছেলে আর বিকিনি পরা মেয়ে দেখলে চোখের আরাম হয়। কিছুই না পরা ছেলে মেয়ে দেখলে তো মনের আরাম হয়। মানুষ যে প্রকৃতির সন্তান, তা তো নগরীর কোলাহলে অনেকটা ভুলতে বসেছি।’’
লেখা পড়ে কেউ কেউ বডি শেমিংএর অভিযোগ করেছে। কেউ কেউ বলেছে আমি ওই লেখাটিতে একেবারেই পলিটিক্যালি কারেক্ট নই। সে কারণে লোকে বাজেভাবে রিয়্যাক্ট করেছে। কিন্তু আমার কথা হলো, আমি আবার পলিটিক্যালি কারেক্ট কবে হলাম? চিরকালই আমি পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট। সে কারণেই আমার শত্রুর শেষ নেই, সে কারণেই ফতোয়া, মিছিল, হুলিয়া জারি, দেশ থেকে বিতাড়ন, বই ব্যান। অন্য দেশেও একই পরিস্থিতি, গৃহবন্দিত্ব, রাজ্য থেকে বিতাড়ন, দেশত্যাগে বাধ্য করা। সর্বত্র ব্রাত্য আমি।
আমি বেড়াল ভালোবাসি বললে কিছু লোক ঘেউ ঘেউ করে উঠবেই, বলবে, আমি কুকুর ভালোবাসি না। সুতরাং কুকুরপ্রেমীরা এক জোট হয়ে আমার কুৎসা রটাবে। একবার আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘটনার বর্ণনা করেছিলাম এভাবে, মেয়েরা দূরপাল্লার বাসে বসে ছিল, বাস মাঝপথে থামার পর পুরুষেরা বাইরে গিয়ে প্রস্রাব করে এল, মেয়েরা প্রস্রাব আটকে বাসেই বসে রইলো। অমনি লোকেরা বলতে শুরু করলো, আমি নাকি বলেছি মেয়েরা ছেলেদের মতো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করুক। একবার লিখলাম, মুসলমান পুরুষেরা চার বিয়ে করতে পারে, ইসলাম ধর্ম পুরুষকে এক সঙ্গে চার স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে, অমনি লোকে বলতে শুরু করলো, আমি নাকি মেয়েদের চার বিয়ের অধিকার চাইছি, অর্থাৎ মেয়েরা যেন চার স্বামী নিয়ে এক সঙ্গে এক ঘরে বাস করতে পারে। আমি যতটুকু ভাবি, তার চেয়ে বেশি ভেবে নেয় কিছু পাঠক। কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক আমার বদনাম করা।
মেয়েদের শরীরের কোন অংশ, এবং পুরুষের শরীরের কোন অংশ দেখতে ব্যক্তি আমি পছন্দ করি, তা জানানোর পর কিছু লোক ঘেউ ঘেউ করে উঠেছে, কী পোশাক কাকে মানায়, কাকে মানায় না তা বলাতেও ঘেউ ঘেউ। এর মানে আমি নাকি মেয়ে বা পুরুষ যারা কোন পোশাক পরলে আমার চোখে মানায় না বলেছি, তাদের বডি শেমিং করছি। আমরা তো দিন রাতই বলছি, এ পোশাক ওকে মানাবে, সে পোশাক তাকে মানাবে। মোটাদের জন্য এক ধরণের পোশাক, স্লিমদের জন্য আরেক। লম্বাদের জন্য এক রকম, বেঁটেদের জন্য আরেক। তরুণীদের জন্য এক রকম, বৃদ্ধাদের জন্য আরেক। আওয়ারগ্লাস বডি হলে এক রকম, না হলে আরেক রকম। এসব বিভিন্ন পোশাক-কোম্পানিগুলোই তৈরি করে। ফ্যাশান ম্যাগাজিনগুলো বলে দেয় কার কী পরা উচিত। আমার ব্যক্তিগত মত, স্তন স্যাগ করলে পুশ আপ পরলে ভালো, বুক খোলা ব্রাহীন ড্রেস না পরাই ভালো। আর স্যাগ না করলে খোলা রেখে চললেও ঠিক আছে। এ বডিশেমিং নয়, বরং বডিশেমিং থেকে মেয়েদের বাঁচানো। এর নাম সত্য কথন। চরম তসলিমাবিদ্বেষীরাও তা জানে। জানে কিন্তু মুখে উল্টোটা বলবে।
এরা ঘেউ ঘেউ করবেই , বেঁটেকে বেঁটে কেন বললাম, লম্বাকে লম্বা কেন বললাম, মোটাকে মোটা কেন বললাম, স্লিমকে স্লিম কেন বললাম। সুন্দরকে সুন্দর কেন বললাম, তাহলে অসুন্দরদের তো বডি শেমিং করে ফেললাম, সুদর্শনকে সুদর্শন কেন বললাম, তাহলে তো কুদর্শনের বডি শেমিং করে ফেললাম, মোদ্দা কথা সর্বনাশ করে ফেললাম! আমি কাউকে বলিনি তুমি দেখতে বেঁটে তুমি লম্বা আলখাল্লা পরো না, আমি বলিনি, তোমার স্যাগিং স্তন, তুমি ভুলেও স্তন দেখানো ড্রেস পরো না। যার যে পোশাক পরার ইচ্ছে, সে পোশাক সে পরবে। আমার কোনটা ভালো লাগছে, কোনটা ভালো লাগছে না, তা আমি বলবো। এতে এত ঘেউ ঘেউ এর কী আছে? ওয়েট, যদি বলিই তোমাকে এই পোশাকে মানাচ্ছে না, যদি উপদেশই দিই এটা পরো না, ওটা পরো, তাতে এত বিচলিত হওয়ার কারণ কী? আমি তো দিন রাত মেয়েদের উপদেশ দিচ্ছি , হিজাব বোরখা পরো না, ওসব পোশাক নারী নির্যাতনের প্রতীক, ওসব পোশাক পরলে নিরেট যৌনবস্তু ছাড়া তোমার আর কোনও পরিচয় থাকে না। আমার উপদেশ কজন মেয়েই বা শুনছে! কিন্তু আমি তো সারা জীবনই এই উপদেশ দিয়ে যাবো, আমার এই মত আমি প্রকাশ করবোই, যতই আমাকে ‘চয়েজ’বাদীরা গালি দিক।
নারীর অনেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে অনেকে মনে করে নারীর ”লজ্জাস্থান”। লজ্জাস্থান নিয়ে কথা বলাটাই তাদের কাছে স্পর্ধা বলে মনে হয়েছে। সুতরাং আমার স্পর্ধা তারা মানবে কেন? তা না মানুক, আমার তো স্পর্ধা দেখাতে জুড়ি নেই।
সত্য কথন, বা ভিন্নমত কোনওকালেই সমাজের অধিকাংশ কূপমণ্ডুক সহ্য করতে পারেনি। আজ হঠাৎ কী ঘটে গেল যে সহ্য করবে? আমি আশাও করি না। বিরুদ্ধ স্রোতে আমি জীবন ভর চলেছি। অতীতে চলেছি, আজও চলছি, যতদিন বাঁচি চলবো। এ নিয়ে আমার কোনও দুঃখ নেই।
সত্তরের দশকে আমি দিব্যি প্যান্ট সার্ট পরতাম। স্কার্ট টপ পরতাম। লোকে মুগ্ধ চোখে দেখতো আর বলতো, কী স্মার্ট রে বাবা। আশির দশকে জিন্স পরতাম, টিশার্ট পরতাম। বড় সানগ্লাস পরতাম। কাঁধে ইয়াশিকা ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় হাঁটতাম। ফটো তুলতাম। সালায়ার কামিজ পরলে ওড়না পরতাম না। চুল বয়কাট রাখতাম। লোকে দেখতো আর বলতো, বাহ বিরাট স্মার্ট তো । নব্বইএর দশকের শুরুতে যখন ইচ্ছে শাড়ি, যখন ইচ্ছে স্কার্ট, জিন্স, প্যান্টস, টপ, শার্ট, টিশার্ট। লোকে বলতো, বেশ স্মার্ট তো । আর এখন ২০২২ সাল। জিন্স আর টি শার্ট পরলে লোকের মার খেতে হয়। মারের আসল কারণটা হলো ”জিন্স টি শার্ট ছেলেদের পোশাক, তুই ছেলেদের পোশাক পরলি কেন, তোর ওড়না কোথায়? তুই হিজাব পরলি না কেন?বোরখাই বা কেন পরলি না? মুসলমানের মেয়ে মুসলমানের পোশাক পরবি। ‘
আসলে একটা বদ হাওয়া বয়ে গেছে গত দুই দশকে। এই বদ হাওয়া ধর্মান্ধ নারীবিদ্বেষী দেশের সংস্কৃতি হিজাব আর বোরখাকে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। বদ হাওয়াটা মানুষের মস্তিস্ককেও বদ করে দিয়েছে। এরমধ্যে নরসিংদী রেলস্টেশনে কিছু মেয়ে জিন্স-টিশার্ট পরে গিয়ে হেনস্থার ঘটনার প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ খুবই জরুরি। কিন্তু আমার মনে হয়, শুধু জিন্স টিশার্ট পরে প্রতিবাদ করলে খুব বেশি লাভ হবে না। বদ হাওয়াটাকে দূর করতে হবে।