বিশ্ব কুইজিন…..

বাঁচার জন্য খাওয়া নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচা – এ ভাবনার কোনও মীমাংসা নেই। তবে যার জন্যই যা হোক না কেন, রসনা তৃপ্তিতে তৎপর হই আমরা সবাই। আলুসেদ্ধ ভাত পরম তৃপ্তি দিলেও মাঝে মাঝে আমাদের স্বাদকোরকগুলি একটু বদল চায়। আর সেই বদল অবশ্যই সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে রেখেই আমরা করতে চাই। কেউ কেউ আবার সারা পৃথিবীর কড়াই খুন্তির লড়াইকেই চেখে দেখতে চান। সেই কথা মাথায় রেখেই যুগশঙ্খ ডিজিটালে বিশ্ব কুইজিন । আজ ওপার বাংলার রসনাতৃপ্তিতে বাংলার খাবারের গল্প ।
অভী নীলোৎপল: আজ শোনাব বাংলার দুই মিষ্টি পদের গল্প। দুটির সঙ্গেই মধ্যযুগের সম্পর্ক। প্রথমটি মধ্যদক্ষিণবঙ্গের প্রিয় খাবার “লাউয়ের পায়েস”। একে অনেকগুলি নামে ডাকা হয়ে থাকে। সাধু ভাষায় দুগ্ধ-অলাবু অর্থাৎ দুধ-লাউ। আবার লাউয়ের ক্ষীরও বলেন অনেকে। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর অন্যতম প্রিয় আহার্য ছিল এটি। চৈতন্য মহাপ্রভুর দুধ লাউ খাবার বর্ণনা রয়েছে বিভিন্ন সাহিত্যে। শান্তিপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা অঞ্চলের এই বিখ্যাত খাবারটি রান্না করে চমকে দিতে পারেন সকলকে।
দ্বিতীর খাবারটি ‘সিন্নি’ বা ‘শিরণি’। পড়েই ভাবছেন তো, এ আর এমন কি! ছোট থেকেই খেয়ে আসছি। আসলে যেটি আপনি খেয়ে আসছেন, সেটি অনেক কারণেই অস্বাস্থ্যকর। সেটিকেই বেশ পুডিং-কাস্টার্ডের আঙ্গিকে একটি রেসিপি আকারে পরিবেশন করব আজ। মধ্যযুগ থেকে আজ অবধি সত্যপীর ও নারায়ণের সংমিশ্রণ সত্যনারায়ণের পুজোর এটি অপরিহার্য অঙ্গ। পুববাংলার অজস্র মাজারে সিন্নি চড়ানো হয়। আগেকার দিনে পুববাংলার মাঝি-মল্লারা বিপদ্গ্রস্ত হলে পাঁচ পীরের নামে সিন্নি মানত করতেন বলেও শুনেছি। আজকে এই দুটি মিষ্টি রেসিপি আপনাদের জন্য দিলাম। বানিয়ে খান, খাওয়ান।
লাউয়ের পায়েস
দানা বিহীন একদম কচি লাউ নিন একটি, মাঝারি দেখে। খোসা ছাড়িয়ে গ্রেট করে ফেলুন বা একেবারে ঝিরিঝিরি করে কেটে ফেলুন। কড়াইতে ঘি দিন অকৃপণ হাতে। তাতে দিন তেজপাতা। দিয়ে দিন লাউ। ঢাকা দিন। খানিকবাদে নাড়াচাড়া করে ভেজে নিন। নাড়তে থাকুন যাতে লাউয়ের রঙ না ধরে যায়। মনে রাখবেন লাউয়ের রঙ কিন্তু সাদাই থাকবে। লাউ থেকে খানিক জল বার হবে। নাড়তে নাড়তে সেই জল শুকিয়ে নিতে হবে। এবার অন্তত ৫০০ মিলিলিটার ফোটানো ঘন দুধ দিয়ে দিন কড়াইতে। নাড়তে থাকুন। লাউ একদম গলে যাবে। দুধের সঙ্গে মিশে গিয়ে ঘন হয়ে এলে মিষ্টি দিন। বাতাসা আর চিনি মিলিয়ে দিতে পারেন, স্বাদ আরও ভালো হবে।
এখন চিনি থেকে বেরোনো জলটাও শুকিয়ে নিন সেই নাড়তে নাড়তেই। ইচ্ছেমতো কাজু কিশমিশ দিয়ে দিন এইবেলায়। এইবার খানিকটা খোয়াক্ষীর ছড়িয়ে দিন। তারপর নামিয়ে ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন। সামান্য এলাচ গুঁড়ো দিতে পারেন সুঘ্রাণের জন্য। এই দুগ্ধ-অলাবুর প্রসঙ্গ পাবেন মঙ্গলকাব্যে। একই রান্না গরম মশলা সহযোগে যশোর, বাগেরহাট, খুলনা জেলায় খাওয়া হয় লাউ-ভুনা নামে। সবই একইরকম পদ্ধতি। খালি দুধ ফোটানোর সময় তাতে গোটা গরম মশলা দিয়ে ফোটাতে হবে। আর এক্ষেত্রে লাউ একেবারেই মিশে যাবে দুধের সঙ্গে। আর দুধের কোনও তরল ভাব থাকবে না।
স্বাস্থ্যকর শিরণি
দুধ নিন এক কেজি। ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নিন। এবার তাতে আড়াইশো সুজি ফেলে দিন। ঠাণ্ডা দুধে ভিজিয়ে রাখুন। সুজি ফুলতে থাকুক। এইবার আপনার হাত দুটি কনুই অবধি ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিন। ব্লেন্ডারে করলে বা হ্যান্ড ব্লেন্ডার দিয়ে করলে এ জিনিস হবে না। হাত লাগবেই। তাই ভালো করে হাত ধুয়ে নিন। এবার আলাদা বড় পাত্রে ১৫ টা মতন পাকা কলা নিন। মর্তমান বা কাঁঠালি হলেই সবচেয়ে ভালো। হাত দিয়ে খুব ভালো করে চটকে নিন কলাগুলো। যাতে একেবারে লেই লেই হয়ে যায়। এবার এতে ২৫০ গ্রাম গুড়ের বাতাসা আর ২৫০ গ্রাম চিনির বাতাসা ভেঙে দিন। মাখতে থাকুন। যাতে কলা আর বাতাসা মিশে যায়। এক্ষেত্রে আপনি বাতাসাকে গ্রাইন্ডারে মিহি করে নিতে পারেন। এবার এর মধ্যে ভিজিয়ে রাখা সুজি আর সব দুধটা দিয়ে দিন। সামান্য ময়দা চাইলে দিতে পারেন, না ও দিতে পারেন। এবার হাতের কাছে মিষ্টি ফল যা যা থাকে যেমন আপেল, নাসপাতি, শীতের সময় হলে পাকা নারকেলি কুল, খেজুর, আমসত্ত্ব, শশা সব কিছু ঝিরিঝিরি করে কেটে ফেলুন। যত চিকন হবে, খেতে তত মজা। এবার সেসব ফল দিয়ে দিন মিশ্রণে। হাতের কাছে মাখা সন্দেশ বা কাঁচাগোল্লা বা নরম পাকের সন্দেশ থাকলে খান পাঁচ/ছয় দিয়ে দিন। ভালো করে মেখে নিন। এবার ২০০ গ্রাম মতন খোয়াক্ষীর মিশিয়ে দিন মিহি করে। কাজু কিশমিশ দিন। আপনার স্বাস্থ্যকর শিরণি তৈরি। এবার পরিবেশনের সময়ে বড় রসগোল্লা সহ এই শিরণি পরিবেশন করুন। শিরিণির গামলায় রসগোল্লা ঢেলে রাখুন। বাটি করে সকলের হাতে দেবার সময় একটি করে রসগোল্লা সহ শিরণি পরিবেশন করুন। আপনার ধন্য ধন্য পড়ে যাবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, যারা এটি পুজোয় নিবেদন করতে চান, তারাও একই পদ্ধতিতে করতে পারেন। এতে কোনও অনিয়ম নেই। কারণ সত্যনারায়ণের সিন্নির নিয়ম হল গোধূম চূর্ণ দিতে হবে। অর্থাৎ গমের গুঁড়ো। সুজিও গমেরই গুঁড়ো। তাই আপনাকে অস্বাস্থ্যকর আটা দিতেই হবে এমন কোনও কারণ নেই। কাঁচা দুধ বা আটা ভুলেও দেবেন না। পুজোতে হলেও পাস্তুরাইজড দুধই ব্যবহার করুন।
কৃতজ্ঞতা – লাউ ভুনার রেসিপিটি বন্ধু শাশ্বত জামানের কাছে পাওয়া।